হারিয়ে যেতে বসেছে করাতি পেশা
করাতিদের গাছ কাটার সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা পেশা বদল করেছেন। আর যে কয়জন এখনো এই কাজে যুক্ত রয়েছেন তারা আছেন শেষ রক্ষায়।
বিভিন্ন জেলার মতো এক সময় মৌলভীবাজারেও গ্রামে গ্রামে করাতি সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতেন। তারা প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুম এলেই বিভিন্ন জেলা থেকে দল বেঁধে এসে বসবাস করতেন। তাদের পেশাই ছিল গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে গাছ কাটার কাজ নেয়া। সে সময় গাছ কাটতে হলে করাতিদের অপেক্ষায় থাকতেন গৃহস্থালিরা। বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে লাভজনক অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় করাতিরা আজ বিলুপ্ত প্রায়। তবুও জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে এখনো দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এ পেশাকে ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। নব্বই দশকের আগেও করাতিদের গাছ কাটার দৃশ্য দেখতে পাড়ার ছেলেরা ভিড় করতেন। গানের সুরে তাল মিলিয়ে তারা করাতিদের কাজে হাত দিতেন।
আর করাতিরা সকাল সকাল গুড়-পান্তা খেয়ে কাজে নেমে পড়তেন। ওই সময় করাতি দলের তিন সদস্য গাছ কাটায় নিয়োজিত থাকলেও অন্যজন ব্যস্ত হয়ে পড়তেন রান্নার কাজে। এভাবে পুরো মৌসুম কাটিয়ে দিতেন তারা। কয়েক মাসে গ্রামের সব কয়টি গাছ কেটে চিরে তারা বাড়ি ফিরতেন।

জানা যায়, সে সময় করাতিরা মাটিতে গর্ত করে বা কাঠের কাঠামো তৈরি করে করাত চালিয়ে গাছ কাটতেন। এই ধরনের করাত চালাতে উপরে আর নিচে অন্তত দুই বা ততোধিক লোকের প্রয়োজন হয়। হাতলযুক্ত করাত দিয়ে উপর-নিচ টেনে একটি গাছ থেকে বিভিন্ন সাইজের কাঠ চিরানো হয়। তৈরিকৃত বিম আর তক্তা দিয়ে ঘরের ছাউনি ও নানা রকম আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। সে সময় কাঠ চিরতে আকার ও প্রকার ভেদে বর্গফুট হিসেবে মজুরি নিতেন করাতিরা।
একটি মাঝারি সাইজের গাছ কাটা ও চিরানোতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ পড়তো। আর তাতে সময় লাগতো তিন দিনেরও বেশি। বর্তমানে আধুনিকতার উৎকর্ষে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার এক সময়ের করাতি।
গ্রামে এখন ঢেউ লেগেছে যান্ত্রিক করাতের। বিভিন্ন হাট-বাজারের করাতকলে অতি কম খরচে অল্প সময়ের মধ্যে চাহিদা মাফিক কাঠ চিরানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে আসবাবপত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যান্ত্রিক করাতকলের কদর বেড়েছে।
১৬ মার্চ মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সামনে বিশাল আকারের একটি গাছ কাটতে দেখা যায় দেলওয়ার, কালু মুন্সি, হাসেম ও নূর মিয়া এ চারজন করাতিকে।

তারা বলেন, শেষ রক্ষায় আমরা আছি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে এ পেশা। মাঝে মধ্যে বড় গাছগুলো যখন মেশিনে তোলা কষ্টকর হয়, তখন আমরা এগুলোকে ছোট সাইজ করে দেই।
মৌলভীবাজার জেলায় কাজ করতে আসা প্রবীণ করাতি মুন্সী বিল্লাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে আমরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে আমার বাবা এ কাজ করতেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমি এ কাজ করে আসছি। তবে শুধু এ পেশার উপর নির্ভর করে টিকে থাকা এখন আর কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।’
কথা হয় রাজনগর উপজেলার করাতি শামসুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে বাপ দাদার সঙ্গে কাজ করতাম এখন আধুনিক করাতকল স্থাপন হওয়ায় ওই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। বর্তমানে ‘অলি করাত মিল’ নামে এক করাতকলে কাজ করি।’
মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পান্না দত্ত জানান, প্রেস ক্লাবের আঙ্গিনায় চাম্বল জাতের ২৫ বছরের পুরানো গাছ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে।
আব্দুল আজিজ/জেডএইচ/এমএস