করোনায় বাগেরহাটে চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়, তীব্র পোনা সংকট
দেশে চিংড়ি উৎপাদনে শীর্ষ জেলা বাগেরহাটে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি শিল্পে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। একদিকে রফতানি বন্ধ থাকার কারণে চাষিরা পাচ্ছেন না ন্যায্যমূল্য, অপরদিকে মৌসুমের শুরুতে ঘের পরিচর্যা শেষে রেণু পোনা সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে না পাড়ায় গত বছরের মতো এবারও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার চাষিরা। এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চিংড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।
জেলায় ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘেরের (খামার) সঙ্গে জড়িত ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন চিংড়ি চাষি। তবে করোনার এই ক্রান্তিকালে তাদের দুঃসময় যাচ্ছে। রফতানি বন্ধ থাকায় বিক্রয়যোগ্য চিংড়ির দাম কমে গেছে। এতে করে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্যমূল্য থেকে। রফতানি বন্ধ থাকায় গত এক বছরে সরকারি হিসাবে বাগেরহাট জেলায় সবমিলিয়ে চিংড়ি শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। বাজারে পোনা সংকটও দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাগেরহাটের চিংড়ি খামারগুলোতে ৭৭ কোটি বাগদা ও ২১ কোটি গলদা পোনার চাহিদা রয়েছে। তবে গত ১৪ এপ্রিল থেকে চলমান লকডাউনে চিংড়ি পোনা পরিবহন ব্যবস্থা অচল থাকায় দেখা দিয়েছে চিংড়ির রেণু পোনার চরম সংকট। এমন অবস্থায় মৌসুমের শুরুতে ঘেরে চাহিদা অনুযায়ী পোনা ছাড়তে না পারায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার চিংড়ি চাষিরা। আর এ কারণেই গলদা-বাগদার পোনার দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
বাগেরহাট মৎস্য অধিদফতর বলছে, করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি শিল্পে জড়িত চাষি ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাগেরহাট মৎস্য অধিদফতরের হিসাব মতে, বাগেরহাট জেলায় চিংড়ি চাষি রয়েছেন ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন। আর ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন বাগদা ও ১৬ হাজার ৩৩৭ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে।
ফয়লা হাটের চিংড়ি পোনা সরবরাহের সঙ্গে জড়িত হেদায়েত শেখ জাগো নিউজকে জানান, গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের কারণে অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ।
ফয়লা হাটের পোনা কিনতে আসা চিংড়ি চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকে ঘের প্রস্তুত করে বসে আছেন। লকডাউনের কারণে হাটের আড়তগুলোতে পোনা না আসায় ঘেরে তারা পোনা ছাড়তে পারছেন না। আড়তে রেণু পোনার সংকটের পাশাপাশি এর দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে এক হাজার বাগদার পোনা বিক্রি হতো ৩০০ টাকা, এখন তার দাম ৬০০ টাকা। নদীর বাগদা ছিল ৭০০ টাকা, এখন ১৪০০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। আর গলদার রেণু পোনাও খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। যা পাওয়া যাচ্ছে তার এক হাজারের দাম চাওয়া হচ্ছে ৩২০০ টাকা।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর চিংড়ি আড়তদার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, করোনার এই সময়ে চিংড়ি শিল্পে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কেজিপ্রতি ১৭০০ টাকার চিংড়ি মাছ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, এই চিংড়ি শিল্প থেকে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়। তাই এই চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাষিদের সরকারি সহয়তার প্রয়োজন। তা নাহলে চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
আড়তদার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কক্সবাজার থেকে বাগদা ও গলদা পোনা আসে এই হাটে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এই হাটে প্রায় কোটি টাকার গলদা-বাগদার পোনা বেচাকেনা হয়। তবে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে হাটে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আগের মতো চিংড়ি পোনার সরবরাহ না থাকায় চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবারাহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে জেলার ৯৫ শতাংশ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জানতে চাইলে বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, চিংড়ি শিল্পেও করোনার প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে রফতানি বন্ধ থাকায় দাম অনেকটা কমে গেছে। এর ফলে জেলার প্রান্তিক চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রফতানি বন্ধ থাকায় গত এক বছরে বাগেরহাটের চিংড়ি শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০ কোটি টাকা। আর সবমিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে বাজারে পোনা সংকটও দেখা দিয়েছে।
তবে তিনি জানান, চাষিদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে জেলার ২৮ হাজার মৎস্য চাষিকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পোনা সংকট সমাধানে কাজ চলছে বলেও জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।
শওকত আলী বাবু/এসআর/এএসএম