প্রফেসর রেজাউলের কারণে করোনা পরীক্ষায় সেবা পাচ্ছেন কক্সবাজারবাসী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কক্সবাজার
প্রকাশিত: ১০:৩৩ এএম, ১১ মে ২০২১

করোনা মোকাবিলায় গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য, হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনের সব দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরও চেনা-অচেনা অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অনেকে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু আগের মতো খুলে দেয়া হয়।

কিন্তু চলতি বছরের একই সময়ে আবারও বিস্তার লাভ করে করোনা। গত বছরের চেয়ে আরও বেশি করোনা রোগাক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও। তাই মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আবারও লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। যদিও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কমতে শুরু করেছেন করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।

এত কিছুর মধ্যেও কক্সবাজারের মানুষ দিনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিনেই পেয়ে স্বস্তিতে সময় পার করছেন। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারায় ভোগান্তি ও মৃত্যুর হার কমছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। গত ৮ মে পর্যন্ত কক্সবাজারের ল্যাবে করোনা পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন এক লাখ ৪০ হাজার ৮১৯জন।

এটি সম্ভব হচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের একমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজটিতে তিনটি পিসিআর ল্যাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারায়, এমনটি দাবি শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ও করোনা স্বেচ্ছাসেবী আনোয়ার হোসেনের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসাপাঠ দিতে প্রায় প্রতিটি বিভাগের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য ল্যাব দরকার। এর মাঝে বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ অন্যতম। এসব বিভাগের মাঝে প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজির আবার কয়েকটি পৃথক ধাপে আলাদা ল্যাব স্থাপন করা দরকার পড়ে। মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের জেনারেল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবটি সংক্রমণ রোগতত্ত্বসহ নানা মহামারিতে রোগের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয়ে কাজ দেয়। আর যেকোনো মেডিকেল কলেজ এ ধরনের ল্যাব একটির বেশি স্থাপন করে না।

কিন্তু কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে জেনারেল মাইক্রোবায়োলজির তিনটি ল্যাব চলমান রয়েছে। শুরুতে কলেজের প্রয়োজনে একটি ল্যাব স্থাপনের পর আইসিডিডিআরবির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ) মাধ্যমে আরও একটি ল্যাব বসানো হয়। পরে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ায় রোহিঙ্গাদের সেবা সুচারু করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য (ডব্লিউএইচও) আরও একটি ল্যাব স্থাপন করে। এ তিনটি ল্যাবে দিনে দিনেই অর্ধসহস্রাধিক করোনা টেস্টের রিপোর্ট সরবরাহ দিয়ে দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. রেজাউল করিমের দূরদর্শী চিন্তার কারণে আজ করোনার নমুনা পরীক্ষায় সুফল দিনে দিনে পাওয়া যাচ্ছে।

নিয়ম মতে, একটি জেনারেল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব স্থাপন হলে একদিনে এত পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়া কোনোমতেই সম্ভব হতো না।

২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা মেডিকেল কলেজটির স্থায়ী ক্যাম্পাস সদরের পাওয়ার হাউস এলাকাতে ২০১৬ সালের শেষের দিকে স্থানান্তরিত হয়। নতুন ভবনে সবকিছু নতুনই বসানো হয়েছে। এসময় অন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবের সাথে একাধিক জেনারেল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব স্থাপনের বন্দোবস্ত করেন তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. রেজাউল করিম। ২০১৭ সালে শেষের দিকে এবং ২০১৮ সালের শুরু হতে রোহিঙ্গাদের নানা রোগের পরীক্ষার মাধ্যমে জেনারেল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব পাঠক্রমের পাশাপাশি জনস্বার্থে ব্যবহার শুরু হয়।

কলেজের পিসিআর ল্যাব ও আইসিডিডিআরবির ফিল্ড ল্যাবটি মিয়ানমার হতে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দেয়া নানা রোগের দ্রুত রিপোর্ট প্রদানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০২০ সালের করোনা পরীক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটিসহ তিনটি পিসিআর ল্যাব এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৬০ লাখ মানুষের ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তিনটি পিসিআর ল্যাবে দৈনিক ১১০০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৬০০ নমুনা পরীক্ষার পর রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে।

করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা, মৃতদের দাফনসহ ঝুঁকি নিয়ে নানাভাবে কাজ করা কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘কক্সবাজারে একাধিক পিসিআর ল্যাব স্থাপন না হলে তখন হয়তো অনেক নমুনা চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় পাঠাতে হতো এবং ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হতো দুই থেকে চারদিন। এতে আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত সম্ভব হতো না। ফলে রোগ সম্পর্কে ধারণা পেতে দেরি হলে অনেকে সঠিক চিকিৎসার আগেই অঘটনের শিকার হতেন হয়তো।’

কক্সবাজার সদরের বাসিন্দা দুবাই প্রবাসী মুহাম্মদ ইউনূস খান, সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ শাহ আলম, রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির জাহাঙ্গীর আলমসহ আরও অনেক বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলাম। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আবার কর্মস্থলে ফিরতে হয়েছে। করোনার এ কঠিন সময়েও মাত্র ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়ে প্লেন ধরতে সুবিধা হয়েছে। নিজ এলাকায় পরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ হওয়ায় এমনটি সম্ভব হয়েছে, নয়তো চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে পরীক্ষা করালে অর্থ ও ভোগান্তি দুটোই যেত।

সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার পর সুস্থ হওয়া কক্সবাজারের সাংবাদিক নেতা রাসেল চৌধুরী ও আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘তেমন কোনো উপসর্গ না থাকলেও শারীরিক অসুস্থতায় চিকিৎসকদের পরামর্শে নমুনা দেয়ার ৫ ঘণ্টার মাথায় রিপোর্ট হাতে আসে। জানতে পারি করোনা পজিটিভ। সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা শুরু করায় অল্পদিন পার না হতেই আবার নেগেটিভ রিপোর্ট আনা সম্ভব হয়েছে। কক্সবাজার মেডিক্যালে এসব পিসিআর ল্যাব না বসলে হয়তো এসব সুযোগ ভোগ করা হয়ে উঠতো না।’

একটির স্থলে একাধিক পিসিআর ল্যাব বসানোর কারণ সম্পর্কে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বর্তমানে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের শহর কক্সবাজার বিশ্ব পর্যটনের একটি উর্বর স্থান। এখানে দেশি-বিদেশি মিলে বছরে লাখ লাখ পর্যটক আসেন। আমি এ মাটির-ই সন্তান। ২০১৭ সাল থেকে উখিয়া-টেকনাফে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা করে সম্ভাব্য চিকিৎসা দুর্যোগ বা মহামারির কথা মাথায় রেখে সুযোগ থাকায় জেনারেল মাইক্রোবায়োলজির একাধিক ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই।

তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম মতো কলেজের একটি স্থাপনের পর, লিখিত আবেদনের মাধ্যমে আইসিডিডিআরবির একটি ফিল্ড ল্যাবের ব্যবস্থা করি। প্রয়োজনে আরও ল্যাব বসানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং সুযোগ রাখা হয়। সেখানে করোনা শুরুর পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে আরেকটি ল্যাব বসানো হয়েছে। এসব করতে গিয়ে অপচয়, পাগলামি, খেয়ালিপনাসহ নিন্দুকের কত মিথ্যাচার শুনতে হয়েছে। কিন্তু সেই খেয়ালিপনার (নিন্দুকের ভাষায়) সুফল আজ কক্সবাজারবাসী, শরণার্থী, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের অর্ধকোটি লোকজন পাচ্ছেন। এটা তৃপ্তির।’

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, ‘গেল ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তিনটি পিসিআর ল্যাবে চলতি বছরের ৮ মে পর্যন্ত কক্সবাজার-বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক লাখ ৪০ হাজার ৮১৯ জনের পরীক্ষা করা হয়। এতে পজিটিভ হয়েছেন ১০ হাজার ৪৩০ জন। কক্সবাজার জেলায় পরীক্ষার আওতায় আসা ৮৩ হাজার ৭৬১ জনে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৩৫৯ জন।

তিনি আরও জানান, বান্দরবান জেলায় ৫ হাজার ৬৩৩ জনে শনাক্ত হয়েছে ৯১৩ জনের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১১ হাজার ৮০১ জনে শনাক্ত হয়েছে ৪৫৯ জনের। রোহিঙ্গাদের পরীক্ষার আওতায় আসা ৩৯ হাজার ৬৭১ জনে পজিটিভ এসেছে ৬৯৬ জন। করোনার শুরু হতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার জেলায় মারা গেছেন ১০০ জন। এর মধ্যে ১১ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে কক্সবাজারবাসীর জন্য গর্বের। এখানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমেত ল্যাবে পর্যাপ্ত সেবা পাওয়ায় দ্রুত চিকিৎসা পাচ্ছে করোনা আক্রান্তরা। কমেকের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর রেজাউল করিমের দূরদর্শিতার কারণে এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। উনার নির্ধারিত সেই কক্ষে আরও একটি পিসিআর ল্যাব বসানোর উদ্যোগ চলছে।’

সায়ীদ আলমগীর/এসজে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।