করোনায় ভালো নেই বেদে সম্প্রদায়
কালের আবর্তে ঐতিহ্যবাহী সাপের খেলা হারিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন বেদেরা। তাই, এখন আর আগের মতো গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে সাপের খেলা দেখা যায় না। নারী বেদেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাপ দেখিয়ে দাঁতব্যথা সারানো, দাঁতের পোকা সারানো ও তাবিজ বেচাসহ দিয়ে ছাড়ানোসহ বিভিন্নভাবে রোজগার করতেন বেদেরা।
তাদের পুরুষ সঙ্গীরা জীবিকা নির্বাহ করতেন সাপ, বানরের খেলা দেখিয়ে কিংবা অন্য কোনো কাজ করে। পুরুষ সাপুড়েরা গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে কিংবা ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন পূর্বে ভাসমান জীবনযাপন করলেও বর্তমানে নদ-নদী, খাল-বিল চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় নৌকায় অবস্থান না করে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলছেন। কমে আসছে তাদের সংখ্যাও।
শুক্রবার (৩০ জুলাই) ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া খালপাড় এলাকায় ৮ থেকে ১০ জন বেদে মহিলার একটি দল দেখা যায়। সেখান থেকে তারা এক দুজন করে যে যার মতো চলে যায়।
সেই দলের এক বেদে সদস্য পারুল। তিনি সাপের খেলা দেখাতে চর ঈশ্বরদিয়া এলাকার একটি বাড়িতে ঢোকেন। বেদে মহিলা বাড়িতে ঢুকতে দেখেই বাড়ির শিশু ও নারীরা সাপের খেলা দেখতে ভিড় জমান।
প্রথমেই বেদে পারুল একটি সাপ বের করে বাড়ির মহিলাদের ১০ টাকা করে নিয়ে আসতে বলেন। এরপর তিনি তাদের বলেন, ‘যদি কোনো শিশু ও নারীর ওপর কোনো কু-নজর (বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়) থাকে তাহলে কালনাগিনী ১০ টাকা নেবে না। কু-নজর না থাকলে নেবে।’
প্রথমেই রাকিব (৭) নামের এক শিশু ১০ টাকা বেদে পারুলের হাতে তুলে দেয়। সাপটি হাতের টাকার কাছে না গিয়ে দূরে দূরে থাকে। এসময় বেদে পারুল ১০ টাকা ফেরত দিয়ে বলেন, ‘ওই শিশুর ওপর কু-নজর আছে।’ এমন বেশ কয়েকজন নারী ও শিশুর কাছ থেকে এভাবেই টাকা নেন বেদে পারুল।
এই প্রতিবেদক বেদে পারুলের হাতে ১০ টাকা তুলে দিলে তা সাপের সামনে তুলে ধনে। তবে সাপটি টাকা নেয়নি। পারুল টাকা ফেরত দিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যান। কিন্তু, আপনার বিপদে কাউকে কাছে পান না। আপনার পেটে পেটে বুদ্ধি। দশ কথায় রাগ করেন না। এক কথায় রেগে যান।’
বেদে পারুল বলেন, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা এভাবেই জীবনযাপন করতেন। আমরাও বিভিন্ন তাবিজ বিক্রি করে সংসার চালাই। বিভিন্ন হাট-বাজারে বীন বাজিয়ে সাপের নাচ দেখিয়ে দর্শক মাতাই। তাবিজ বিক্রি করে দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। এভাবে সংসার চলে গেলেও এ পেশায় জীবনের ঝুঁকি রয়েছে।’
বেদে পারুলের কাছে দুটি সাপ ছিল। একটি তিনি ‘কালনাগিনী’ ও আরেককটিকে ‘দুধরাজ’ বলে জানান। সাপ কিভাবে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কালনাগিনী সাপটি দেশে পাওয়া যায় না। ভারত থেকে বেদে সর্দাররা কিনে এনে ঢাকায় বিক্রি করেন। সেখান থেকে কালনাগিনী সাপটি ৩০ হাজার টাকায় কিনে এনেছি। দুধরাজ সাপটি দেশেই পাওয়া যায়। আমরা নিজেরাই এগুলো ধরতে পারি বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘দেশে করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ কেজি করে একবার চাল পেয়েছিলাম। এরপর আর কোনো সহায়তা আমরা পাইনি। করোনাকালে কোথায় সাপ খেলা দেখাতে গেলে লোকজন জমে। অনেক সময় প্রশাসন বেশি লোকজন দেখে উঠে যেতে বলে। যে কারণে এখন আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি।’
একসঙ্গে ৮ পরিবার পরিবার শম্ভুগঞ্জের স্বপ্নার মোড় (ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা) সড়কে বসবাস করেন বলে জানালেন এই নারী বেদে।
মঞ্জুরুল ইসলাম/এসআর/জেআইএম