ভবন নির্মাণ: রাজশাহীতে শতাধিক স্কুলে ক্লাস চালু নিয়ে শঙ্কা
রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) খুলছে স্কুল-কলেজ। তবে রাজশাহী জেলায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরোনো ভবন সংস্কার কাজ চলমান থাকায় এ দিন ক্লাস চালু নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের অভিযোগ, বার বার ঠিকাদার ও শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগকে কাজ দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিয়েও তারা গড়িমসি করে কাজ করেছেন। এতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে নগরীর শিরোইল কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়, রানীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সায়েরা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়, ছোট বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও আটকৌশিয়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে এখনো ক্লাস চালু করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এতে অনেকটায় বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। তবে অভিভাবক ও স্থানীয়দের দাবি, প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে তদারকি না করায় কাজ শেষ হয়নি। এতে ছেলে-মেয়েদের ক্লাস নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, ভোকেশনাল, মাদরাসাসহ মোট ৯০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে, রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজশাহী জেলায় প্রায় ১২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন নির্মাণসহ পুরোনো ভবন সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এমনই চিত্রের দেখা মিলেছে নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিরোইল কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২৫০ জন শিক্ষার্থীর বিদ্যালয় ভবনটি পাঁচতলা। সেখানে রয়েছে মোট ১৫টি কক্ষ। তার মধ্যে ছয়টি শ্রেণিকক্ষ ঠিকঠাক রয়েছে। আর বাকি ছয়টিতে নির্মাণ কাজ চলছে গত দু’বছর ধরে। তারপরও শেষ হয়নি কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টির নির্মাণাধীন ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে এমনকি ছাদেও চলমান রয়েছে ঢালাই, মোজাইক, দরজা-জানালা লাগানোসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজ। বিদ্যালয় ভবনটির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কক্ষে করা হয়েছে শ্রমিকদের থাকার জায়গা। বেঞ্চ দিয়ে তারা বানিয়েছেন বেড। সিড়িঘরসহ কয়েকটি ঘরে রয়েছে নির্মাণ সামগ্রী। সেগুলোর কোনো ঘরেই বেঞ্চ নেই, ক্লাসরুম পুরোটায় ফাঁকা। অপরিচ্ছন্ন রয়েছে বাথরুমও। ভাঙা পড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঘরের দরজা। সর্বোপরি বলা যায় যে, একেবারেই ক্লাসের অনুপযোগী হয়ে রয়েছে বিদ্যালয়টি।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন প্রামাণিক বলেন, গত দুই বছর ধরে এই নির্মাণ কাজ চলছে। প্রতিদিনই কাজ চলছে, কোনো দিন কাজ থেমে নেই। আমরা সরকার নির্দেশিত যে পদ্ধতিতে রুটিন তৈরি করা দরকার, সেভাবে রুটিনও তৈরি করে ফেলেছি। এমনকি স্যানিটাইজার, মাস্ক, তাপমাত্রা পরিমাপক মেশিনের ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।
নির্মাণ কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেভাবেই হোক নির্মাণ কাজ আজ রাতের মধ্যেই সেরে ফেলা হবে। বাকি থাকবে না। আগামীকাল থেকে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করার পরিবেশ পাবে।
অথচ নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, নির্মাণ কাজ শেষ হতে কমপক্ষে আরও তিন মাস সময় লাগবে। যেসব কাজ বাকি আছে তাতে একদিনে করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
ঠিক একই অবস্থা চারঘাট উপজেলার মৌল ভাগ বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। সেখানেও চলছে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ। পাশেই রয়েছে তিন কক্ষবিশিষ্ট ক্লাসরুম। মাঠ জুড়ে উঁচু করে রাখা হয়েছে মাটি। অফিস রুমের দরজার সামনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে সিমেন্টের বস্তা। ক্লাসরুম গুলোতে রাখা হয়েছে লোহার রড, পাইপ, তার ও টিনের ড্রাম। সবগুলো রুমের তালা খোলা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বসার মতো কোনো পরিবেশ নেই। তারপরও প্রধান শিক্ষক বলছেন, স্কুল খোলার আগেই পাঠদানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু সেখানে বাস্তবে তেমন কোনো পরিবেশ চোখে পড়েনি।
এদিকে উপজেলার নাওদাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানেও তিনরুম বিশিষ্ট ভবনের সামনে পাহাড়সম মাটির স্তূপ। বিদ্যালয়ের মাঠে পা ফেলার মতো জায়গা নেই। রুমের সবগুলো তালা খুলে ভেতরে রাখা হয়েছে নির্মাণ কাজের সামগ্রী।
চারঘাটের জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাগিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিরোজপুর (১) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাবিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুঠিয়ার নন্দনগাছী উচ্চ বিদ্যালয়, বাঘার চকরাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ রাজশাহীর প্রতিটি উপজেলার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
এদিকে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের একই ভাষ্য, ক্লাস শুরুর আগে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক করতে সক্ষম হননি তারা। এতে অনেক অভিভাবকসহ সমাজের সুশীলরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এমন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিনও। তিনি বলেন, আগামী ১২ তারিখ সারাদেশে ক্লাস শুরু হবে। সারাদিন নানা সমস্যার কথা জানিয়ে প্রতিনিয়তই প্রতিটি উপজেলা ও শহরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করা হয়েছে। তারা বারবারই বলেছেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি নিজেই গত বৃহস্পতিবার বাগমারায় গিয়ে দু-একটি স্কুলে এ ধরনের সমস্যা দেখে এসেছি।
তিনি আরও বলেন, ১২ সেপ্টেম্বর সরকার ঘোষিত নির্দেশনা মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হবে। এ নিয়ে আমরা সবাই ব্যস্ত। শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে আমি অফিস করেছি, মাঠ পর্যায়ে দৌঁড়েছি। তারপরও অনেকেই উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন, যা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ভাষ্য, যেসব প্রতিষ্ঠান এমন গড়িমসি করছে তাদের বিষয়ে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি। আগামীকাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হবে। যারা সরকার ঘোষিত নির্দেশনা প্রতিপালনে ব্যর্থ হবেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম বলেন, আমাদের কার্যালয়ে ১২ কোডে কাজ পরিচালনা হয়। তার মধ্যে রাজস্ব কোডে কাজ চলে চারটি। আর এই চারটিই হচ্ছে রিপেয়ার অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন ও দোতলা বা একতলা ভবন নির্মাণের কাজ। এই কাজগুলোতে ঠিকাদারদের বহু টাকা বাকি পড়ে আছে। গত জুলাই মাসে ৪০ কোটি টাকা চেয়ে মাত্র দুই কোটি টাকা বরাদ্দ মিলেছে। চলতি মাসে ৬০ কোটি টাকার পাওনা রয়েছে ঠিকাদারদের। সেক্ষেত্রে আমরা বললেও তারা টাকার অজুহাত দেখিয়ে কাজ শেষ করতে চান না। তাই এ বিষয়ে তেমন জোর দিয়ে কিছু বলার নেই।
এমআরআর