হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ রাখা এক জাপানির গল্প

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা
প্রকাশিত: ০৩:০১ পিএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

অডিও শুনুন

জাইকার সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. শিরো ইয়ামাশোজি বাংলাদেশে কাজ করছেন কয়েক বছর আগে থেকে। তিনি জাপানের Osaka Prefecture Agriculture University এর আধ্যাপক এবং Association to Protect Asian Children from Foodbone Disease (NPO), Japan এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলাদেশে এসে শুধু কাজই করেননি; একখণ্ড বাংলাদেশ যেন তার হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে গেছেন। তাইতো তিনি এখন সুদূর জাপানে থেকেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদের পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য ভাবেন। শিশুদের অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা তাকে ব্যথিত করে। এসব শিশুরা যেন ভালো থাকে সেজন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি মনে করেন, ছোট ছোট কিছু অভ্যাস শিশুদের ভালো রাখতে পারে, তারা ভালো থাকতে পারে। না হলে একটি শিশু সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। শৈশবে রোগাটে থাকায় সারাজীবন সে স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে। জাতি হারায় একজন কর্মঠ মানুষ।

এসব বিষয় খেয়াল করে প্রফেসর ড. শিরো ইয়ামাশোজি শিশুদের ভালো থাকার অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন পাবনার বাসিন্দা সর্দার জাহাঙ্গীর হাসেন। সেবা কার্যক্রম শিশুদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভিত্তিক কাজ শুরু করেছেন।

এনপিও’র বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ড. শিরো ইয়ামাশোজি বাংলাদেশে কাজ করার সময় খুব কাছ থেকে পল্লীর শিশুদের পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি (ড. ইয়ামাশোজি) দেখেছেন শুধু স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে শিশুরা নানা রোগ বালাইয়ে ভোগে। এতে তারা শারীরিকভাবে যে দুর্বলতায় ভোগে ভবিষ্যতে সেই ঘাটতি আর পূরণ হয় না। এতে তারা একটি দুর্বল মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকে। কেউ কেউ পরিবারের বোঝা হয়ে যায়। তবে শৈশবেই ছোট খাট কিছু বিষয়ে সচেতন করতে পারলে তারা নিরোগ শরীর নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। ড. ইয়ামাশোজি সমস্যার মূলে হাত দিয়ে এর সমাধান করতে চান।

সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ড. শিরো ইয়ামাশোজি শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে নানা নিয়ম কানুন দেখানো একটি রঙিন বই তৈরি করেছেন। সেই বইয়ের ছবি দেখে ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে শিশুরা সুস্থ থাকতে পারে। বইটিতে একজন শিশুর সারাদিনের স্বাস্থ্যসম্মত কর্মের ছবি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

সর্দার জাহাঙ্গীর জানান, শিশুরা শুধু সেসব ছবি ব্যক্তিজীবনে অনুসরণ ও অনুকরণ করবে। এতেই সে বিভিন্ন রোগাবলাই থেকে মুক্ত থাকবে। বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যে কিছু স্বাস্থ্য সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ ও উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে।

সর্দার জাহাঙ্গীর জানান, ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনার জন্য হাইজিন এডুকেশন বই, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করে যাচ্ছেন তারা। শিশুরা স্বাস্থ্য সচেতনামূলক রঙিন ও ঝকঝকে বই পেয়ে দারুণ উৎসাহিত। তারা বইয়ে দেওয়া ছবি ও লেখা অনুসরণ করছে। এতে তারা যেসব রোগে সাধারণত ভোগে যেমন ডায়রিয়া, জন্ডিস, বমি, উদারাময় বা কৃমি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন আরো জানান, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন করোনা মহামারি চলছে। এ সময় তারা শিশুদের বই দেয়ার পাশাপশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ করছেন। এক্ষেত্রে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিচ্ছেন। এতে তাদের কাজ দারুণভাবে সাফল্য পাচ্ছে বলে তিনি জানান।

হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ রাখা এক জাপানির গল্প

তিনি জানান, আগামী অর্থবছর থেকে তারা আরো কিছু সেবা নিয়ে গ্রামীণ শিশুদের কাছে হাজির হবেন।

পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এক বিদ্যালয় ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি বড় মাঠ, বিল ও সাঁকো পাড়ি দিয়ে ওই স্কুলে যেতে হয়। সেই স্কুলে গিয়ে কথা হয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র- ছাত্রীদের সঙ্গে।

প্রত্যন্ত এলাকার আরেকটি স্কুল কুমিরগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও চোখে পড়ে ড. শিরো ইয়ামাশোজির সংস্থার কার্যক্রম।

স্কুলের শিশুরা জানায়, তারা স্কুল থেকে ফ্রি মাস্ক পেয়েছে। এখন আবার আরো নুতন মাস্ক পাওয়ায় তারা খুব খুশি।

কুমিরগাড়ী স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিশু সৈকত হোসেন জানায়, তারা ছবির একটি সুন্দর বই পেয়েছে। এছাড়া নুতন মাস্ক পেয়েছে। এতে সে খুব খুশি।

একই স্কুলের ইমরান, বাবলি, মারিয়াসহ অন্যরাও জানায় তারা রঙিন বই আর মাস্ক পেয়ে খুব খুশি।

কুমিরগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা খালেদা বেগম ও রাবেয়া খাতুন জানান, তারা পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য শিক্ষা দেন। শিশুদের নতুনের প্রতি আকর্ষণ বেশি। সে হিসেবে তারা একটি আকর্ষণীয় বই পেয়ে উৎসাহিত। এছাড়া সরকারিভাবে বিতরণ করা মাস্কের পাশাপাশি আরো সুন্দর মাস্ক পাওয়ায় শিশুরা খুশি।

ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানান, সুদুর জাপান থেকে আমাদের বিদ্যালয়ের মতো প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের কথা ভাবছেন ড. শিরো ইয়ামাশোজি। এটা ভাবতেই ভালো লাগছে। তার উদ্যোগে দেওয়া বইগুলো শিশুরা অনুসরণ করে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠবে বলে তিনি আশা করেন।

হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ রাখা এক জাপানির গল্প

এনপিও এর বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, প্রতিষ্ঠাতা ড. শিরো ইয়ামাশোজি ২০১৯ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রাইমারি স্কুলে হাইজিন বা স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়ক বই, মাস্ক বিতরণ ও পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতামূলক কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাইমারি স্কুল শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সচেতনতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে। তারা বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে প্রায় আড়াই কোটি বই ও মাস্ক বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ড. শিরো ইয়ামাশোজির বরাত দিয়ে এনপিও’র বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, জাপানের প্রাথমিক স্কুলে অনেক কিছু শেখানো হয়। জাপানের স্কুলগুলোতে জীবনমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়। শেখানো হয় সামাজিকতা, ন্যায়-অন্যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। কারণ শিশুরা কাদামাটির মতো, তাদের যে রূপ দেওয়া হয় তারা সেই রূপ ধারণ করে।

সর্দার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এদেশে যেহেতু এত সুযোগ সুবিধা নেই বা সহসাই সেটা বাস্তবায়ন হবে না, তাই ড. শিরো ইয়ামাশোজি চাইছেন শিশুরা অন্তত বাড়িতে বড়দের সাহায্য নিয়ে আর স্কুলে শিক্ষকদের সহায়তায় স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে বেড়ে উঠুক।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম জামাল আহমেদ জানান, সুদূর জাপানের একজন মানবদরদি মানুষ প্রফেসর ড. শিরো ইয়ামাশোজি বাংলাদেশের পল্লীর দরিদ্র শিশুদের নিয়ে ভাবছেন এটা প্রশংসনীয়। তিনি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বে-সরকারি সংস্থাগুলো এভাবে এগিয়ে এলে প্রাথমিক সেক্টরে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।

আমিন ইসলাম জুয়েল/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।