স্বাধীন-গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিকপথ পাওয়া সম্ভব: আদালত

ছামির মাহমুদ
ছামির মাহমুদ ছামির মাহমুদ সিলেট
প্রকাশিত: ০৪:৫৪ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২২

জনপ্রিয় বিজ্ঞানলেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশ, পরমতসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতা সভ্যতার অগ্রগতির নির্ণায়ক। এগুলোর চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পেছনের দিকে হাঁটবে। স্বাধীন ও গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিকপথ পাওয়া সম্ভব।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি হামলাকারী ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়েজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি মামলার অপর আসামি ফয়জুলের বন্ধু মো. সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।

মামলার বাকি চার আসামি ফয়জুল হাসানের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে পাঁচ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা দায়রা জজ) নুরুল আমীন বিপ্লব।

মামলার বাদী শাহজলাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।

এদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান আসামি ফয়জুল সম্পর্কে বিচারক বলেন, আসামি ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়েজের দেশ বা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তিনি মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানির বই পড়ে ও বক্তব্য শুনে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতি সংক্ষুব্ধ হন। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্লাগার ও নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলায় বিশেষত শিশুতোষ গ্রন্থ ‘ভূতের বাচ্চা সুলেমান’ লিখে তিনি নবী সুলায়মান (আ.)-কে কটূক্তি করেছেন বলে কাল্পনিক অভিযোগ তুলে তাকে নিজ হাতে হত্যার পরিকল্পনা করেন ফয়জুল। জাফর ইবালকে ইসলামের শত্রু ও নাস্তিক আখ্যায়িত করে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি হত্যার চেষ্টা চালান।

Sylhet-(3).jpg

পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও উল্লেখ করেন, ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী না বুঝে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যাকে পুণ্যের কাজ মনে করে আসামি এই বর্বর হামলা চালিয়েছেন। ইন্টারনেট সাইটে জিহাদি আর্টিকেল, জিহাদি বই পড়ে এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী বক্তার বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন।

‘আর অপর আসামি মো. সোহাগ মিয়া কাপড়র ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ফয়জুলকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন জিহাদি বই, অডিও এবং ভিডিও ক্লিপ সরবরাহ করে দেশের মুক্তমনা লেখকদের হত্যার ব্যাপারে শলাপরামর্শ করতেন।’

শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল সম্পর্কে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মামলার সাক্ষ্য ও নথি পর্যালোচনায় ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, এ মামলার ভিকটিম ড. জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। শিক্ষকতার বাইরেও তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞানলেখক। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে এবং শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করে জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে তার সরব অবস্থার সর্বজনবিদিত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক উল্লেখ করেন, ‘ফয়জুলের এহেন কাজ নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী কাজ, আরও স্পষ্ট করে বললে ধর্মীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশ, ভিন্নমত প্রকাশের জন্য এ দেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ভিকটিমের ওপর এহেন কাজ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

অনলাইনে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার গুরুত্বারোপ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপ কৌশলে ভার্চুয়াল জগতে তাদের উগ্রবাদী সন্ত্রাসী মতবাদ ছড়িয়ে, সহজে বেহেস্ত যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে তরুণ প্রাণে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে। সাইবার জগতে এসব উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদানকারী বিভিন্ন সাইট বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে তাদের প্রচারিত তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরালো ও কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে।

Sylhet-(3).jpg

আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ১০ মার্চ চাঞ্চল্যকর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়। মামলায় ৫৬ সাক্ষীর মধ্যে ৩৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এরপর ২১ ও ২২ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়।

২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়। মাদরাসাছাত্র ফয়জুল হাসান ছুরি দিয়ে জাফর ইকবালের মাথা ও ঘাড়ে উপর্যুপরি আঘাত করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকরা হামলাকারী ফয়জুলকে হাতেনাতে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।

পরে জাফর ইকবালকে আহত অবস্থায় প্রথমে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।

এ ঘটনায় শাবি রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেন।

২০১৮ সালের ১৬ জুলাই ফয়জুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা জালালাবাদ থানার তৎকালীন ওসি শফিকুল ইসলাম। ওই বছরের ৪ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত বহুল আলোচিত এ মামলার রায় দেন।

ছামির মাহমুদ/এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।