লোডশেডিংয়ে শঙ্কার মুখে চা শিল্প

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ১০:৫৫ এএম, ০৭ আগস্ট ২০২২

দেশব্যাপী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং চালু হওয়ার কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে মৌলভীবাজারের চা শিল্প। সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে লোডশেডিং আরো বাড়ছে। লোডশেডিং এখন দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হচ্ছে। এতে উৎপাদন হ্রাসের শঙ্কায় রয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে চা পাতা উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই স্পর্শকাতর। এর প্রক্রিয়া কোথাও থেমে গেলে ওই পাতা নষ্ট হয়ে যায়। অথবা এর মান নষ্ট হয়ে যায়। এখন চায়ের ভরা মৌসুম। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চায়ের উৎপাদন। শঙ্কা দেখা দিয়েছে চায়ের গুণগত মান রক্ষা নিয়েও।

এর প্রভাব পড়বে চা রপ্তানি বাজারেও। চায়ের মান খারাপ হলে রপ্তানিও করা যাবে না। আবার রপ্তানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কাও থাকবে। এতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চায়ের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে।

বাগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা জেনারেটর চালিয়েও চায়ের কারখানাগুলো আর সচল রাখতে পারবে না। জ্বালানি সংকট ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এটা সম্ভব হবে না।

Tea-(5)

আর মৌলভীবাজারের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানিয়েছে, এ ধরনের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে সহসা উত্তরণের কোনো পথ নেই।

চায়ের রাজধানী খ্যাত দেশের সিংহভাগ চা উৎপাদন হয় এই জেলায়। সারা দেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলাতেই রয়েছে ৯২টি। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় এখানকার চা। তবে হঠাৎ করে লোডশেডিংয়ের কারণে সংকটে পড়েছে এই চা শিল্প।

চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ করে লোডশেডিং তীব্র হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এই সময় প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে এই কাঁচা পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যায় পড়ছে বাগান কর্তৃপক্ষ।

দিনে একাধিকবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ার কারণে ব্যবহার করতে হচ্ছে জেনারেটর, আর তাতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এর মধ্যে সরকার জ্বালানি তেলের বাড়ানোয় খরচ আরও বেড়ে গেছে।

Tea-(5)

রাজনগর মাথিউরা চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. সিরাজুদ্দৌলা জাগো নিউজকে বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে আমরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছি। আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎতের বিকল্প হিসেবে আমাদের জেনারেটর চালাতে হয়। আর জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেল। সেই ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। আবার পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ। যে কারণে জেনারেটার চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

চানভাগ চা বাগানের ব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান বলেন, এখন আমাদের চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এই মুহূর্তে যে বাগানে চা পাতা একেবারেই কম তাদেরও ৯/১০ হাজার কেজি পাতা আসে ফ্যাক্টরিতে। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণেই আমাদের ২৪ ঘণ্টা কারখানা চালু রাখতে হয়। আমরা পাতা সংরক্ষণ করে রাখতে পারি না, দিনেরটা দিনেই প্রোসেস করতে হয়। তাই লোডশেডিংয়ের জন্য সামগ্রিকভাবে আমাদের বেশ ক্ষতি হচ্ছে।

জেলার রাজনগর ইটা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আদিল জাগো নিউজকে বলেন, চা উৎপাদনের খুব ক্ষতি হচ্ছে, আমরা একটানা ১২ ঘণ্টা ফ্যাক্টরি চালাতে পারছি না। জেনারেটর ব্যবহার করছি। সময়ে অসময়ে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। একটানা যদি ফ্যাক্টরি না চলে তাহলে চায়ের গুণগত মান নষ্ট হয়। চা উৎপাদনে ৪ থেকে ৫টি ধাপে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে যদি ১টা ধাপে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হয়।

Tea-(5)

তিনি আরও বলেন, বাগান থেকে পাতা উত্তোলনের পর থেকেই বিদ্যুতের প্রয়োজন। এই কাঁচা পাতা ফ্যান চালিয়ে একটানা ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা টার্ফে রাখতে হয়। তারপর মেশিনে তুলতে হয় তখন যদি একঘণ্টা চলার পর মেশিন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পাতা মেশিনে আটকে নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলী জাগো নিউজকে বলেন, এখন চা উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে আমাদের সবগুলো বাগানেই চা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সকল যন্ত্রপাতি আবার অনেক সময় জেনারেটরে চালানো সম্ভব হয় না। চা উৎপাদন প্রক্রিয়াটা খুবই স্পর্শকাতর। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে হয় পাতার মান নষ্ট হবে না হলে পাতায় ভাপ ধরে নষ্ট হবে। তাছাড়া সবকিছুর দাম বাড়লেও চায়ের দাম কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। এখন এই সমস্যার জন্য গুণগতমান যদি কমে যায় তাহলে চায়ের দামও কমে যাবে।

Tea-(5)

এদিকে বাংলাদেশ চা বোর্ডের বিশেষজ্ঞদের মতে, এবছর দেশে মোট চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ বিলিয়ন কেজি। কিন্তু লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কথা হলে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন,সহসাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয় তাহলে এটার একটা সুরাহা হবে। তাছাড়া শীতকাল এলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে। বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা পিক আওয়ারে ৯০ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ৬০ মেগাওয়াট। অফপিক আওয়ারে চাহিদা ৫৫ মেগাওয়াট এবং সরবরাহ ৪০ মেগাওয়াট।

চা শিল্পের বিদ্যুৎ সমস্যার ব্যাপারে তিনি বলেন, একটি বা দুটি চা পাতা তৈরির কারখানা হলে আমরা তাদের আলাদা গুরুত্ব দিতে পারতাম। কিন্তু এখানে একাধিক কারখানা রয়েছে। তাই আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।

আব্দুল আজিজ/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।