লোডশেডিংয়ে অর্ধেকে নেমেছে উৎপাদন, বিপর্যস্ত তাঁতশিল্প

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৪:১৮ পিএম, ২০ আগস্ট ২০২২

তাঁতের শাড়ি-লুঙ্গিসহ নানা পোশাক তৈরিতে একটি সমৃদ্ধ জেলা হিসেবেই পরিচিতি সিরাজগঞ্জ। এখানকার উৎপাদিত তাঁত পণ্য ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। গত দুই বছর করোনা মহামারি ও বন্যার কারণে এই শিল্পে ধস নেমে আসে। ফলে এই অঞ্চলের তাঁত কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এখন পর্যাপ্ত কাপড় তৈরি করতে পারলে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। তবে সম্প্রতি চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেয়ে অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঘনঘন লোডশেডিংয়ে জেলার তাঁতশিল্পের উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

শুক্রবার (১৯ আগস্ট) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলায় সরজমিনে দেখা যায়, লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা মালিকরা ডিজেলচালিত জেনারেটরের সাহায্যে তাঁত কারখানা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডিজেলের দামবৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। লোডশেডিংয়ের ফলে থ্রি-পিস, লুঙ্গি, শাড়ি ও গামছা তৈরিতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আবার যেসব কারখানায় জেনারেটর নেই সেসব কারখানার শ্রমিকরা কখন বিদ্যুৎ আসবে সেই ভরসায় অলস বসে আছেন।

লোডশেডিংয়ে অর্ধেকে নেমেছে উৎপাদন, বিপর্যস্ত তাঁতশিল্প

জেলা তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের ৯ উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার তাঁত রয়েছে। আর এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক মিলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ জড়িত।

জেলার বেলকুচি উপজেলার চন্দনগাঁতি সাহপাড়া গ্রামের তাঁত শ্রমিক আবু ইউসুফ বলেন, আগে দিনে ৩-৪ পিস কাপড় বুনতে পারতাম। লোডশেডিংয়ের কারণে দিনে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ যায়। একেক বার বিদ্যুৎ গিয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আসে না। বিদ্যুৎ না থাকায় রাত ও দিন মিলে এখন দুটি শাড়ি বোনাও কঠিন হয়ে গেছে। এতে আমাদের আয়ও কমেছে। যে টাকা কামাই করি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এভাবে কতদিন চলবো তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।

একই উপজেলার তামাই গ্রামের তাঁত শ্রমিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিং শুরু হওয়ার আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে দুই থেকে তিন হাজার টাকার কাজ করতো। বিদ্যুৎ যেভাবে আসে যায় তাতে এখন এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা কঠিন হয়ে গেছে। আগে বিদ্যুৎ গেলে মহাজন জেনারেটর চালাতো এখন তেলের দাম বাড়ার কারণে জেনারেটর চালাতে দেয় না। যার কারণে আমাদের কামাই কমে গেছে। যা কামাই করি তা দিয়ে সংসার চলে না।

শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী গ্রামের শ্রমিক আব্দুল আজিজ বলেন, তাঁতের বাজার মন্দা থাকার কারণে মহাজন ঠিকমতো কাজ দিতে চায় না। তার মধ্যে আবার শুরু হয়েছে লোডশেডিং। এতে আমাদের আয় কমে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে চলতে পারছি না। এখন কী করে খাবো তাও খুঁজে পাচ্ছি না।

রায়গঞ্জের ব্রহ্মগাছা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রহিজ উদ্দিন বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বিদ্যুৎ জ্বালাতন শুরু করেছে। যার কারণে আমাদের কাজ কমে গেছে। এভাবে যদি বিদ্যুৎ জ্বালায় তাহলে সংসার চালাবো কীভাবে। এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছি।

লোডশেডিংয়ে অর্ধেকে নেমেছে উৎপাদন, বিপর্যস্ত তাঁতশিল্প

বেলকুচির রায় প্রডাক্টসের মালিক রিপন সাহা বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। কিন্তু হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জেনারেটরও চালানো যাচ্ছে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা জেনারেটর চালু রাখলে পাঁচ-সাত লিটার তেল প্রয়োজন হচ্ছে। এই কয়েক ঘণ্টার জন্য এক হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক বেশি।

জৈতি শাড়ি ঘরের স্বত্বাধিকারী শ্রী বৈদ্যনাথ রায় জানান, তাঁত সরঞ্জাম ও রং-সুতার দামবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ব্যবসা এমনিতেই কমে গেছে। তার ওপরে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। গত কয়েক সপ্তাহে লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের কাপড় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এদিকে, যাও উৎপাদন করছি তা আবার খরচের তুলনায় কম দামে পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। এমন করে চলতে থাকলে একদিন এই শিল্প হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ পাওয়ালুম অ্যান্ড হ্যান্ডলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে অধিকাংশ তাঁত কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আগে বিদ্যুৎ না থাকলে আমরা জেনারেটরের সাহায্যে কারখানা চালু রাখতাম। এখন আর সে উপায়ও নেই। কারণ তেলের দামও বেড়েছে। তাই আমরা বাধ্য হয়েই এখন বিদ্যুৎ চলে গেলে কারখানা বন্ধ রাখছি। আর কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকেরাও কাজ করতে পারছেন না। আর যতটুকু কাপড় তৈরি করা হচ্ছে, তাও ন্যায্য দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের।

তিনি আরও বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে লাখো শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পরিবারের তাগিদে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে কারখানা চালানো যাচ্ছে না। তাঁত মালিকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

তাই এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এমআরআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।