কৃষক ছানোয়ারের কলেজে শেখানো হয় কৃষির প্রতি ভালোবাসা

আরিফ উর রহমান টগর আরিফ উর রহমান টগর টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ০৪:৫৭ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২৩

ফসল বিক্রির টাকায় নিজ জমিতে কলেজ নির্মাণ করেছেন ছানোয়ার হোসেন নামে এক কৃষক। কলেজে বোর্ড নির্ধারিত শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন ‘ভালোবাসার কৃষি উৎপাদনমুখী শিক্ষা’ নামের একটি ক্লাস কার্যক্রম। এতে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি কৃষি বিষয়ক শিক্ষাও পাচ্ছে কলেজে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ স্থানীয় শিক্ষানুরাগীরা।

কৃষক মো. ছানোয়ার হোসেন (৫০) টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের মো. জামাল উদ্দিনের ছেলে। ছানোয়ার হোসেন পেশায় একজন কৃষক হলেও ১৯৮৮ সালে মধুপুরের চাপড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে কালিহাতী কলেজ থেকে এইচএসসি আর ১৯৯২ সালে মধুপুর কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস কোর্স সম্পন্ন করেন।

২০১৩ সালে ছানোয়ার হোসেন তার মালিকানাধীন ১৩৫ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন মহিষমারা কলেজ। ২০২২ সালে কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়। বিজ্ঞান ও মানবিক এই দুই বিভাগে কলেজটির বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২৭ জন। এর মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ মিলে বিজ্ঞান বিভাগে ৫২ আর মানবিক বিভাগে অধ্যায়নরত রয়েছে ২৭৫ জন শিক্ষার্থী। কলেজের স্টাফ সংখ্যা ১৭ জন। এর মধ্যে শিক্ষক ১২ জন। অধ্যক্ষ ব্যতীত বিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন, মানবিক বিভাগে ৪ আর বাংলা, ইংরেজী ও আইসিটি বিষয়ে ৩ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন কলেজটিতে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি কক্ষবিশিষ্ট কলেজের একটি একতলা একাডেমিক ভবন রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ভবনটি নির্মাণ করে। ভবনের সামনেই রয়েছে নজরকাড়া বড় একটি কৃষি বাগান। বাগানজুড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ সূর্যমুখী ফুলের গাছ, মাঝে টমেটো, মরিচ, বাঁধাকপি, ঢেঁঢ়শ, পেঁয়াজ, রসুন, বরই, লাল ও পালং শাকসহ নানা ধরনের শাক-সবজি ও ডালিয়া, গাঁদা ফুলের বেশ কিছু গাছ। ওই বাগানের পাশেই রয়েছে উৎপাদনমুখী শিক্ষা নামের একটি সাইন বোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে বছরব্যাপী ফসল উদপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও গবেষণা কার্যক্রম।

রফিক, মনসুরসহ একাধিক এলাকাবাসী বলেন, ছানোয়ার হোসেন একজন বড় মনের মানুষ। গ্রামের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখার জন্য নিজের জমিসহ কৃষি থেকে কষ্টে উপার্জিত টাকায় মহিষমারা কলেজটি নির্মাণ করেছেন। কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগও দিয়েছেন স্বচ্ছভাবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কৃষিশিক্ষাও দিচ্ছেন তিনি। তার কাজ সবাই পছন্দ করেন। এ থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।

কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী রহিমা বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি উৎপাদনমুখী শিক্ষাটি খুবই ভালো লাগছে। নিজেদের খাবার নিজেরাই যেন উৎপাদন করে খেতে পারি সেজন্যই উৎপাদনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করছি।

কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মনির হোসেন বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি আমরা যেন উৎপাদনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করি সেই চেষ্টা করছেন সফল কৃষক ছানোয়ার হোসেন। কৃষি শিক্ষা নিতে আমাদের খুবই ভালো লাগে। এখানে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে কাজ করি। এরই মধ্যে আমরা পেঁয়াজ ও আলু রোপণ করেছিলাম। তিন কেজি আলু থেকে আমরা ত্রিশ কেজি আলু পেয়েছি। এক মাচায় ১২ মাস সবজি আবাদ করবো সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে আছে।

তিনি বলেন, উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আমাদের ৫টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি শনিবার ভোর ৬টা থেকে এ কার্যক্রমে আমরা অংশগ্রহণ করি। এখানে উৎপাদিত ফসল আমরা বিক্রি করে উৎপাদনমুখী শিক্ষা ফান্ডে জমা করি।

কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, কৃষি প্রধান দেশ আমাদের। এছাড়াও আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছানোয়ার হোসেন একজন কৃষিমনা মানুষ। তিনি কৃষিকে ভালোবাসেন। তার উদ্যোগেই কালেজ প্রাঙ্গণে আমরা উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্যই একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বাবা-মা যে কৃষিকাজ করেন, সেটা যেন তারা করতে পারে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরও যেন তারা কৃষি কাজ করতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই আমরা কলেজের সব শিক্ষার্থীকে এই উৎপাদনমুখী শিক্ষায় সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, এই বাগানের সব ফসলই শিক্ষার্থীদের রোপণকৃত। আমরা চাই এই শিক্ষার্থীরা যেন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর কৃষিকে ভুলে না যায়।

কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা খুবই কষ্টকর। এ এলাকার চারদিকে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কলেজ নেই। এলাকার ছেলে-মেয়েদের কিভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় সে ভাবনা থেকেই কলেজটি করা।

তিনি বলেন, বংশ পরম্পরায় আমি কৃষক। প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ আমি কৃষি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এর মাঝে ১৯৯৩ সালে সিলেটের রেঙ্গাহাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ বছর ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আর ঘাটাইলের গারোবাজার সুনামগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ২ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি। তবে শিক্ষকতা পেশা ভালো না লাগায় আবার কৃষিতে ফিরে আসি। যদিও কৃষিতে আমাদের কোনো সিলেবাস নেই। এরপরও সিলেবাসবিহীন কৃষিতেই আমি সফল মানুষ।

তিনি আরও বলেন, এই দেশে সাড়ে ৩ কোটি তরুণ ও যুবক আছে, যারা নিজেদের বেকার মনে করে। ওই তরুণ ও যুবকরা যদি কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে আর কিছু উৎপাদন করে তাহলে আমাদের দেশে যে পরিমাণ জমি আছে তাতে ১৭-১৮ কোটি না ৩৬ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এই বিশ্বাস থেকেই আমি উৎপাদনমুখী কার্যক্রমটি শুরু করেছি। এখানে বই পড়ে শেখা না, দেখে দেখে আর কাজ করে শেখানো হয়। এই বাগানে যা দেখা যাচ্ছে সবই কলেজের ছেলে মেয়েরা করেছে। ওদের মধ্যে যারা ভালো করে তাদের দিয়ে অন্যদের শিখাই। ওদের মধ্যেই ছাত্র, ওদের মধ্যেই শিক্ষক। এখানে তিনশ শিক্ষার্থী আছে, ওই তিনশ শিক্ষার্থীর বাড়িতেও যদি কিছু কিছু উৎপাদন করতে পারি তাহলে সেটি দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে। আমি সেই শক্তিশালী লোকগুলো তৈরি করে দিচ্ছি, যাদের থাকবে উৎপাদনের হাত। ওই হাতে ফসল উৎপাদন হবে, আরেকজন খাবে।

মহিষমারা কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কলেজটি আজ তার (ছানোয়ার) প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের থেকে তুলনামূলক দুর্বল শিক্ষার্থীরা কলেজটি ভর্তি হওয়া সত্তেও এরই মধ্যে এইচএসসি সম্পন্ন করেছে কলেজের ৭টি ব্যাচ।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে এ কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ আর জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন। গত এইচএসসি পরীক্ষায় ৯৬ জন শিক্ষার্থীর ৯৫ জনই পাস করেছে। এর মধ্যে ৩ জন গোল্ডেন এ প্লাসসহ ১৬ জন পেয়েছে এ প্লাস।

মহিষমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মহির উদ্দিন জানান, কৃষিপ্রেমী মানুষ ছানোয়ার। কলেজের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও ভবনসহ সরকারি নানা সহযোগিতাও পাচ্ছে কলেজটি। কলেজটি হওয়ায় স্থানীয় শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতেও তাদের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।