বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ

পৈতৃক ভিটা জরাজীর্ণ, আর্থিক টানাটানিতে স্বজনরা

এন কে বি নয়ন এন কে বি নয়ন ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০১:০২ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৩

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের পৈতৃক ভিটা জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যাতায়াতের ইটের রাস্তাটির অবস্থাও খারাপ। স্মৃতি জাদুঘরে নেই উল্লেখযোগ্য স্মৃতি-সংগ্রহ। আর্থিক টানাটানিতে দিন কাটছে এ বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের সদস্যদের।

সাত বীরশ্রেষ্ঠের অন্যতম ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের সালামতপুর (বর্তমানে রউফনগর) গ্রামে। ১৯৪৩ সালের মে মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীতে যোগ দেন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মুন্সি আব্দুর রউফ। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির মহালছড়ি বুড়িঘাট এলাকায় নৌপথে শত্রুর শেলের আঘাতে তিনি শহীদ হন।

তার মৃত্যুর খবরটি পরিবারের কাছে পৌঁছে ২০ এপ্রিল। তারপর থেকে ওই দিনটিই বীরশ্রেষ্ঠের শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন তার পরিবারের সদস্যরা। তার নামে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০৭ সালের ১৭ নভেম্বর। জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় তিন হাজার ৫৩৫ বর্গফুটের এ স্থাপনাটি; ২০০৮ সালের ২৮ মে উদ্বোধন করা হয়।

Forid-(2).jpg

বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের সদস্যরা জানান, মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের রউফনগর গ্রামের মসজিদের ইমাম মেহেদি হাসানের একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন মুন্সি আব্দুর রউফ। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে পরিবারের উপার্জনের হাল ধরতে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (সংক্ষেপে ইপিআর) যোগ দেন। মা মুকিদুন্নেসা বেগম মারা গেছেন। বীরশ্রেষ্ঠের দুই বোনের মধ্যে বড় বোন জহুরা বেগম দুই সন্তানকে নিয়ে পৈতৃক ভিটায় থাকেন। ছোট বোন হাজেরা বেগম পাশের জেলা রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সাংগুরা গ্রামে থাকেন।

নদীতে বিলীন হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের সড়ক

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার একমাত্র সড়কটি দীর্ঘদিনেও সংস্কার করা হয়নি। মধুমতি নদীভাঙনের কারণে সড়কটি দিনের পর দিন নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। সড়কটি দিয়ে রিকশা-ভ্যান চলা তো দূরের কথা, হেঁটে চলাও কষ্টকর। বৃষ্টি এলে সড়কটি দিয়ে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে এ গ্রামে আসেন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতি দেখতে। কিন্তু যাতায়াতের সড়কটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি আজও। ইট বিছানো এ রাস্তায় জায়গায় জায়গায় গর্ত। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে পারে না।

Forid-(2).jpg

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পরে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের পরিবারের জন্য জমিসহ একটি বসতবাড়ি নির্মাণ করেছিল সরকার। তবে সরকারি সে বাসভবনে থাকেন না মুন্সি আব্দুর রউফের পরিবারের স্বজনরা। বড় বোন জহুরা বেগম থাকেন বাবার পুরোনো ভিটায়। ছোট বোন হাজেরা থাকেন রাজবাড়ী। মুন্সি আব্দুর রউফের মা মুকিদুন্নেসা বেগম জীবিত থাকতে তার দেখাশোনা করতেন ইয়াকুব মোল্যা নামের এক ব্যক্তি। তারা দুজনই মারা যাওয়ার পর বাড়িটি বর্তমানে ইয়াকুব মোল্লার পরিবারের দখলে রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের বাড়ি ও স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে জরাজীর্ণ বসতভিটা। বাড়ির চারপাশ আগাছা, লতাপাতা আর আবর্জনায় ছেঁয়ে গেছে। ঘরের চারপাশ ও ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। দরজা-জানালাও ভাঙা। ঘরের মধ্যে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে ঘরটি।

গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটির বড় একটি কক্ষের ভেতরে রয়েছে মুন্সি আব্দুর রউফের ব্যবহার্য চীনামাটির দুটি প্লেট ও একটি বাটি, মুক্তিযুদ্ধের দুটি পোস্টার ও কিছু বই। স্মৃতি জাদুঘরে স্মৃতি বলতে কেবল এতটুকুই।

গ্রন্থাগারে মোট পাঁচ হাজার ১৮৮টি বই রয়েছে। পাঠকদের বসার জন্য রয়েছে টেবিল-চেয়ার। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র দুজন। যে কারণে সেখানে দর্শনার্থীদের পদচারণা খুবই কম।

Forid-(2).jpg

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সহপাঠী খবির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মুন্সি আব্দুর রউফের বসতভিটার অবস্থা জরাজীর্ণ—একটি ভাঙা বিল্ডিং। এটি সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।

বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফের ভাগনে হায়দার মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ আমার মামা। মামার রক্তের সম্পর্কের মধ্যে তার দুই বোন জহুরা বেগম (৬৬) ও হাজেরা বেগম (৬৩)। তারা এখনো জীবিত রয়েছেন। আমার মা জহুরা বেগম মামার বসতভিটায় থাকেন। আমাদের নিজেদের থাকার ঘরটিও ভালো না। আমার নানি বেঁচে থাকার সময় সরকার যে ঘরটি তুলে দিয়েছিল সেটিও এখন বসবাসের অযোগ্য। আমাদের চাওয়া বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ যেখানে থাকতেন সে জায়গাটি যেন সরকার রক্ষণাবেক্ষণ করে তার স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়।’

স্মৃতি জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা শহীদ পরিবারের সদস্য ও লাইব্রেরিয়ান মুন্সি সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু একটি রাস্তার অভাবে এখানে দর্শনার্থীরা আসতে চান না। ইটের ভাঙাচোরা যে সরু রাস্তাটি আছে সেটি দিয়ে বড় যানবাহন চলাচল সম্ভব হয় না। রাস্তাটি পাকা করা প্রয়োজন। জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মারক নেই। দর্শনার্থীরা এসে স্মারক না দেখে কষ্টমনে ফিরে যান।’

Forid-(2).jpg

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমরা শহীদ পরিবারের সদস্য। অথচ দীর্ঘদিনেও আমার চাকরিটা স্থায়ী হয়নি। চাকরি স্থায়ী করার জানান তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা তায়েব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের জন্মস্থান, গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার একমাত্র ইটের রাস্তাটি ভাঙাচোরা। তার বসতবাড়িটিও বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক।

কামারখালীর বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের জন্ম আমাদের এলাকায়, যা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। কিন্তু এত বছরেও এখানে উন্নয়নের ছোঁয় লাগেনি হয়নি।

Forid-(2).jpg

প্রতিবেশী রুস্তম মৃধা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি তখন তাকে (বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ) দেখেছি। চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে আসতেন। তিনি ফুটবল ও হাডুডু খেলা পছন্দ করতেন। তার হাতে চারজন ঝুলেও হাত নামাতে পারতাম না।’

আক্ষেপ করে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের ছোট বোন জহুরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে খোঁজখবর নেওয়া হলেও বাকি সময় আমাদের ভালোমন্দের খবর কেউ রাখে না। পরিবারের কারও চাকরি-বাকরি, সরকারি অনুদান কিছুই পাই না। ভাঙাচোরা ঘরে বসবাস করছি। একটি ভাতা পাই, তা দিয়েই কোনোমতে চলে।’

jagonews24

তিনি বলেন, ‘অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে চলছে আমাদের সংসার। জন্মভিটায় কোনো দর্শনার্থী এলে আপ্যায়ন করতে পারি না। বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। এজন্য নিজেদের কাছে অনেক খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। কিন্তু কিছুই করা সম্ভব হয় না।’

এ বিষয়ে মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিবিজড়িত বসতভিটা বাউন্ডারিসহ পরিমার্জিত ও সুরক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মধুমতি নদীর ভাঙন থেকে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি রক্ষা করতে এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

jagonews24

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল আহসান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের সদস্যদের দাবিগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের বসতভিটা ও স্মৃতি জাদুঘর, রাস্তাঘাট, মধুমতি নদীভাঙন রোধে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।