কৃষিনির্ভর নীলফামারীতে শিল্পায়নের ছোঁয়া

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নীলফামারী
প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ২৬ মে ২০২৩

গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফাইন্যান্সের (আইএনএম) একটি গবেষণার তথ্যমতে, একটা সময় নীলফামারীতে দিনে তিনবেলা ভাত খেতে পারতো না ২৩ শতাংশ মানুষ। সেসময় এ অঞ্চলের একটি পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল গড়ে ৩৫ হাজার ৪০০ টাকা। এ অঞ্চল ছিল কৃষিনির্ভর। বছরের বেশিরভাগ সময় কৃষিকাজ না থাকায় বেকার থাকতো অধিকাংশ মানুষ। মৌসুমী এই বেকারত্বের ফলে দেখা দিতো খাদ্যাভাব৷ মঙ্গা কবলিত এলাকা বলেই পরিচিত ছিল নীলফামারী।

তবে শিল্পায়নের হাতছানিতে বদলে গেছে মঙ্গা কবলিত নীলফামারীর মানুষের জীবনমান। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে উত্তরের এই জেলায় গড়ে উঠেছে একের পর এক শিল্প কারখানা। বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। দিন দিন মুছে যাচ্ছে অভাব শব্দটি।

jagonews24

জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করতে ২০০১ সালে উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ২১৩.৬৬ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয় এই ইপিজেড। ইপিজেড প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জেলাজুড়ে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পকারখানা। যেসব কারখানায় কাজ করছেন এ অঞ্চলের কয়েক লাখ শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। এতেই বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা। কর্মসংস্থান হওয়ায় মিলেছে অর্থনৈতিক মুক্তি।

বর্তমানে উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ১৯০টি প্লটের মধ্যে ১৫৪ প্লটে ২৪টি দেশি-বিদেশি কোম্পানির কারখানা আছে। এর মধ্যে ১১টিই বিদেশি কোম্পানি। এছাড়াও জুতা তৈরি, পিভিসি পাইপ, কুটিরশিল্প, পরচুলার কারখানাসহ ছোট ছোট প্রায় ৬০টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।

উত্তরা ইপিজেডসহ বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, এসব কারখানায় বেতন, উৎসব-ভাতা ও মাতৃত্বকালীন সুবিধাসহ শ্রমিকদের পাওনা সঠিক সময়ে পরিশোধ করা হয়। এতে সন্তুষ্ট শ্রমিকরা।

jagonews24

আরও পড়ুন: শিল্পায়নের পথে বাংলাদেশ

ব্যবসায়ীর বলছেন, কারখানাগুলোতে রয়েছে দক্ষ জনশক্তি, আছে সুন্দর কর্মপরিবেশ। নেই রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো প্রভাব। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন বেশি। এতে বাড়ছে কলকারখানা, বাড়ছে শ্রমিকের চাহিদাও।

উত্তরা ইপিজেডে এভারগ্রীন কোম্পানিতে কাজ করেন রেজাউল ইসলাম। কয়েক বছর আগেই যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো তার। এখন একটি ব্যাংকে সঞ্চয় করেন তিনি।

রেজাউল ইসলাম বলেন, পরিবারের বড় ছেলে আমি। দাদি, বাবা, মা ও বোনসহ ৫ জনের পরিবার৷ বাবার একার আয়ে খুব অভাবে দিন কাটতো আমাদের। কয়েক বছর হয় কাজ করছি৷ অভাব এখন নেই। মাসের খরচ শেষে কিছু টাকা ব্যাংকে রাখি। ভালোই যাচ্ছে দিন।

jagonews24

আরও পড়ুন: উত্তরাঞ্চলের শিল্পায়নে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ 

নাসরিন আক্তার নামের আরেক শ্রমিক বলেন, প্রতি মাসের বেতন প্রতি মাসে পাই। এতে ঝামেলা হয় না৷ সুন্দরমতো সংসার চলে। ধার-দেনা করতে হয় না। আগে খুব কষ্ট ছিল আমাদের।

ইকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক বলেন, ইকো গ্রুপ প্রতি বছর কোটি টাকার পাটজাত পণ্য রপ্তানি করছে। এছাড়া তাদের কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ১২ হাজারের বেশি শ্রমিকের।

একটি জুতা কারখানার জেনারেল ম্যানেজার মমিনুল ইসলাম বলেন, দিন দিন আমাদের সবকিছুই সহজলভ্য হচ্ছে। কোনোভাবে যদি চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু হয়, তাহলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আরও কলকারখানা স্থাপন হবে।

jagonews24'

আরও পড়ুন: রংপুরে যেন মঙ্গা ফিরে না আসে : প্রধানমন্ত্রী

নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি প্রকৌশলী এস.এম শফিকুল আলম ডাবলু জাগো নিউজকে বলেন, শিল্প উন্নয়নে একের পর এক সম্ভাবনার পথ তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। আর এই শিল্পকারখানাগুলোর জন্য পরিবর্তন এসেছে এ জেলায়। মানুষ এখন স্বাবলম্বী। আশা করি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নীলফামারীতে শিল্পে বিপ্লব ঘটবে।

নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরা ইপিজেড উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করেছে। এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক কোনো ঝামেলা নেই। এ কারণে মানুষ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে৷

তিনি আরও বলেন, শিল্পায়নের ধারাবাহিকতায় উত্তরা ইপিজেডে একটি জুয়েলারি কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স স্মাইল আর্টস কোম্পানি লিমিটেড। যেখানে ৩০০ বাংলাদেশি নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

jagonews24

আরও পড়ুন: মঙ্গা এবার অনেক দূরত চলি গেইছে

নীলফামারী জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, উত্তরা ইপিজেডসহ জেলার বিভিন্ন কারখানার ফলে নীলফামারীসহ আশপাশের জেলাগুলোর হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাইপলাইনে গ্যাস এলে এবং চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু হয়ে এ অঞ্চলের শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হবে। আরও মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

এরইমধ্যে নীলফামারীর চিলাহাটি দিয়ে ভারতে চলাচল করছে আন্তঃদেশীয় ট্রেন মিতালি এক্সপ্রেস। একই পথে চলছে পণ্যবাহী ট্রেন। জোর আলোচনা চলছে চিলাহাটি স্থলবন্দর চালুর প্রসঙ্গে। আগামী জুনে পাইপলাইনে গ্যাসও আসার কথা আছে এই অঞ্চলে। সবকিছু চালু হলে এই অঞ্চল হবে সমৃদ্ধ শিল্প এলাকা। যেখানে কর্মসংস্থানের কোনো অভাব থাকবে না।

এফএ/এএইচ/জিকেএস

উত্তরা ইপিজেড উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করেছে। এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক কোনো ঝামেলা নেই। এ কারণে মানুষ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে— মো. শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক, উত্তরা ইপিজেড

‘শিল্প উন্নয়নে একের পর এক সম্ভাবনার পথ তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। শিল্পকারখানার ফলে পরিবর্তন এসেছে এ জেলায়। মানুষ এখন স্বাবলম্বী।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।