নাগরিকত্ব নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা

নাগরিক অধিকার ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবাসনে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা। এটি নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গা কমিউনিটি। বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে আলোচনায় রোহিঙ্গারা এ দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (২০ জুন) বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে উখিয়া-টেকনাফে শরণার্থী ক্যাম্পে দুপুর থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা সভার আয়োজন করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
সমাবেশের রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালে আরকান রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু করে আমাদের মা-বাবা, ছেলে-সন্তানদের পুড়িয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বিতাড়িত করেছে নিজ দেশ থেকে। আমরা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছি। বাংলাদেশ সরকার আমাদের মানবিক আশ্রয় দিয়েছে। এ দেশের সরকার ও জনগণের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তবে, আমরা আর শরণার্থী হয়ে থাকতে চাই না। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করুন।
সভায় ১০টি বিষয় উল্লেখ করে রোহিঙ্গা নেতারা আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষা ও অবিলম্বে নাগরিকত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের পরিচয়, সংস্কৃতি এবং ভাষা পুনরুদ্ধার করতে হবে। ন্যায় ও জবাবদিহিতার জন্য আইসিসি ও আইসিজের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য চীন ও রাশিয়াকে পাশে চাই আমরা। খুব দ্রুত টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দরকার। রোহিঙ্গাদের মর্যাদা রক্ষা করা ও জাতিগত অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। চিরস্থায়ী বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করতে হবে। আমাদের আরাকানে ফেরত নিতে হবে। শরণার্থীদের অধিকার আইনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা ও মানবতার স্বার্থে অনুগ্রহ করে আমাদের সন্তানদের আনুষ্ঠানিক ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিন। আমরা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।
শরণার্থী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার কামাল বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব, নিজের বসবাসের বাড়িঘর ও জমি, সম্পত্তি ফেরত, জীবিকা ও চলাচলের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজ দেশ মিয়ানমারের ফিরতে চাই। ১৯৮২ সালের আইন বাতিলের মাধ্যমে আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে দ্রুত প্রত্যাবাসনে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হোক- যাতে তারা দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে।
টেকনাফ ২৬ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা বজলুর রহমান বলেন, আমরা চরম দুর্ভাগা। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের ভিকটিম হয়ে অন্য দেশে বোঝার মতো বসবাস করছি। বিশ্ব নেতাদের কাছে বলছি, আমরাও মানুষ। নাগরিকত্ব ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার আমাদেরও আছে। নিজেদের ভিটেমাটিতে অবস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবন-জীবিকানির্বাহের স্বাধীনতা নিয়ে মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারের ফেরত যেতে চাই। প্রতিটা সমাবেশেই আমরা একটি দাবিই বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরে যাচ্ছি।
এদিকে, সাধারণ রোহিঙ্গারা বলেন, আরকান রাজ্য সেনাবাহিনীর দমন পীড়ন ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে আমরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর নানা জটিলতায় ছয় বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। এরইমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো আমাদের অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। গত ১ মার্চ থেকে জনপ্রতি মাসে রেশন ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল। কিন্তু জুন মাসে আরও কমিয়ে জনপ্রতি মাসে আট ডলার অর্থাৎ ৮৪০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এ হিসাবে দৈনিক রেশন কমেছে ৩৩ শতাংশ। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও হতাশায় ভুগছি।
বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করতে দুপুর থেকে শতশত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বাস্তুচ্যুত এ বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদেরও প্রত্যাশা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা (রোহিঙ্গারা) যেন নিজ দেশে ফেরত যেতে পারে।
উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে সাড়ে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবস্থান করছেন। ২০১৮ সালে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত বাছাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এখনো কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি। পরবর্তীতে মিয়ানমার সরকারের নানা কৌশলে তারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশ সরকার তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার লক্ষ্যে গত ২৫ মে বাংলাদেশে আসে মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব সোস্যাল অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ’র নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এর আগে গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল রাখাইন সফর করে। তারও আগে ১৫ মার্চ মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। সে সময় ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমারে ফিরে যায় দলটি।
সায়ীদ আলমগীর/এমআরআর/এমএস