বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের মৃত্যুবার্ষিকী

সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রণাঙ্গনের স্মৃতি

মিলন রহমান মিলন রহমান , জেলা প্রতিনিধি, যশোর
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের যুদ্ধক্ষেত্র ও শাহাদৎ বরণের সাতটি স্থানের একটি যশোরে। এই রণাঙ্গনটি ঝিকরগাছা উপজেলার গোয়ালহাটি-আটুলিয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই স্থানে অসীম সাহসিকতায় সম্মুখ সমরে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে সহযোদ্ধাদের প্রাণ রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। কিন্তু অবহেলা ও উদ্যোগ না নেওয়ায় সেই রণাঙ্গনের স্মৃতিটি মুছে যেতে বসেছে।

দুদশক আগে সেখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও অন্তত একযুগ আগে তা বিলীন হয়ে গেছে। যদিও গতবছর ‘স্মতিফলক আছে’ এই বিতর্কে জড়িয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের পরিবার।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ এর ৫ সেপ্টেম্বর ছুটিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

jagonews24

একসময় সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল এম জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন। শত্রুপক্ষ সরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু হঠাৎ শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে নূর মোহাম্মদের ডান কাঁধে লাগে। ধরাশায়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। হাতের এল এম জি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন। সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ। এ অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে।

সহযোদ্ধারা তার মরদেহ উদ্ধার করে। এ বীরসেনানীকে পরবর্তীতে যশোরের সীমান্তবর্তী কাশিপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধিস্থল ঘিরে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হলেও তার যুদ্ধক্ষেত্র ও শহিদ হওয়ার স্থানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বরং স্থানটি অবহেলিত ও ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, দুদশক আগে সেখানে একটি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করা হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিলীন হয়ে গেছে। গতবছর এই রণাঙ্গনের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন কবি ও গবেষক সাইদ হাফিজ। স্ট্যাটাসে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের শাহাদৎ বরণের স্থানের স্মৃতি রক্ষায় নিজের ‘জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক’ নিলামে বিক্রি করতে চান।

এদিকে কবি সাইদ হাফিজ স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুবুল হক দাবি করেন, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের শাহাদৎ বরণের স্থানে স্মৃতিফলক আছে। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর তিনি সরেজমিনে গোয়ালহাটি-আটুলিয়ার কোথাও কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাননি। বরং মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পরে এসে ঘটনাস্থলটি গোয়ালহাটি না আটুলিয়া তা নিয়ে দুরকম মতামত উঠে আসে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, শাহাদৎ বরণের স্থান যেটিই হোক সেখানে অন্তত একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক।

স্থানীয়রা জানান, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের শাহাদৎ বরণে স্থান ও যুদ্ধক্ষেত্রটির সন্ধানে ঝিকরগাছা উপজেলার ছুটিপুর বাজার থেকে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ সড়ক ধরে ব্যাংদাহর দিকে দু’কিলোমিটার দূরে সেই যুদ্ধক্ষেত্রের একটি স্পট। সড়কটির একপাশে গোয়ালহাটি আরেকপাশে আটুলিয়া। মূলত এ সড়কের পাশ থেকেই বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের মরদেহ উদ্ধার হয়। সড়কের ওপরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তার মাথার অংশবিশেষ।

আটুলিয়া পূর্বপাড়ার ডা. আব্দুস সাত্তার বলেন, আটুলিয়া, গোয়ালহাটি রাস্তার এপার-ওপার। তাই এ নিয়ে বিবাদ করার চেয়ে জরুরি একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স তৈরি হয়। সেখানে জায়গাও আছে। ফলে প্রশাসনের উচিত সেখানে স্মৃতি কমপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নেওয়া।

গতবছর বিষয়টি নিয়ে কথা হলে ইউএনও মো. মাহবুবুল হক জানান, স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছিলেন, স্মৃতিফলকটি আছে। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেটি নেই। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি সেখানে স্মৃতিফলক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। গত একবছরে স্মৃতিফলক নির্মাণে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

jagonews24

তবে গত এক বছরে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ছেলে গোলাম মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাস্তবায়ন করেননি। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সঙ্গে তামাশা করেছেন।’

এ বিষয়ে কবি ও গবেষক সাইদ হাফিজ জাগো নিউজকে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের শাহাদৎ বরণের স্থানের স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য গত দশবছর ধরে বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়ে যাচ্ছি। গতবছর পদক বিক্রির স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরে প্রতিশ্রুতি দিলেও অগ্রগতি হয়নি। প্রশাসন যদি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করে তাহলে আমি নিজেই এটি নির্মাণ করবো।

তবে তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু স্থান নিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য আছে, তাই জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে যথাযথ স্থান নির্ধারণ করে এটি নির্মাণ করা হোক। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পর এটি যেন ভুল স্থানে নির্মাণ না হয়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইউএনও মাহবুবুল হক বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে যেহেতু আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবো।’

এসজে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।