পরচুলায় খুলেছে হাজারও নারীর ভাগ্য

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নীলফামারী
প্রকাশিত: ০৪:৩৯ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৪

নীলফামারীর রামগঞ্জ বিএম কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্রী খুশি রানী। ভ্যানচালক বাবার আয়ে সংসারই চলে না কোথায় তাদের লেখাপড়া শেখাবেন? এক প্রতিবেশীর সহযোগিতায় একটি পরচুলা কোম্পানিতে কাজ নেন খুশি। তার পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। এ রকম হাজারো খুশির জীবন পাল্টে দিয়েছে পরচুলা।

শহরের মেসার্স মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ মাসুদ রানা বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৩০০ জন নারী কাজ করছেন। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে কয়েকটি গ্রামে কাজ দেওয়া হয়েছে। সংসারের কাজের পাশাপাশি গৃহিণী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও অবসরে পরচুলা তৈরি করছেন। এখানে তারা কাজ করে মাসে আয় করছেন ৬-৮ হাজার টাকা।

বর্ণমালা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বর্ষা রায় বলে, পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে পরচুলা তৈরির কাজ করে প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা আয় করি। দুই মাস ধরে সে এখানে কাজ করছে। পড়াশোনার খরচ ছাড়াও পরিবারে সামান্য হলেও সহযোগিতা করছি।

জয়া রানী (৩৮) স্বামী দিনমজুরি কাজ করে পরিবার চালালেও অভাব লেগে থাকে। নিজের হাত খরচ জোগাতে দলবদ্ধ হয়ে তিনিও করছেন পরচুলা তৈরির কাজ।

nil-(3).jpg

তিনি বলেন, প্রতিবেশীর বাড়িতে চুলের কাজ হচ্ছে প্রায় ছয় মাস ধরে। সংসারে সহায়তা ও নিজের প্রয়োজনে কাজ করছি। প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকার কাজ করি।

দুবাছুরী গ্রামের অঞ্জলী রানী রায় (৩৪) জানান, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার পাঁচ সদস্যের সংসার। স্বামী কিশোর চন্দ্র রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তার আয়ে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে তিনি পরচুলা তৈরির কাজ নেন। চুলের কারখানায় কাজ করে তার মাসে আট হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

সংসারের অভাব দূর করতে কেউ অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। কেউ কাজ করতেন দিনমজুরির। যাদের কাজ করার উপায় ছিল না, তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতেন। কিছুদিন আগেও তারা এ রকম দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন। কিন্তু এখন পরচুলা তৈরি করে তাদের অভাব দূর হয়েছে। প্রতি মাসে প্রত্যেকে আয় করছেন ৮-১০ হাজার টাকা। এ টাকায় সংসারের সুখ ফিরে এসেছে নীলফামারীর প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামের নারীদের।

পরচুলা তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা শেফালী রানী রায় বলেন, গ্রামে যারা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন পরচুলা তৈরির কাজ করে তারাও এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমানে একটু রেট কম। পরচুলার কাজ আমাদের এখানে সবসময় থাকে। তাদের সমস্যা আমি দেখে সমাধান করি।

মেসার্স মাসুদ এন্টারপ্রাইজ নামের পরচুলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ মাসুদ রানা জাগো নিউজকে বলেন, আমি শুধু ক্যাশ নিয়ে কাজ করি। এখানে ক্যাশ প্রসেসিং, মেট ও ক্যাশ সাপ্লাইয়ার করে থাকি। আমাদের এ পণ্যের কাঁচামাল গুলো চীন থেকে বিভিন্ন বায়াদের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। আমার এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নীলফামারীত ৩০০ অধিক নারীর কর্মসংস্থান করেছি। সরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে আরও বড় পরিসরে বিদেশি রপ্তানি করাসহ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেত।

nil-(3).jpg

তিনি আরও বলেন, পরচুলা তৈরির জন্য নারীদের ৭-১০ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রত্যেক নারী মাসে ৭-১০টি পরচুলা (চুলের ক্যাপ) তৈরি করতে পারেন। আকারভেদে একটি চুলের ক্যাপ তৈরি করতে একজন নারী শ্রমিক ৩০০-১২০০টাকা পান।

এসব বিষয়ে মেসার্স সাইমা হেয়ার এন্টারপ্রাইজ প্রসেসিং কারখানার ব্যবস্থাপক তারেক রহমান বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় তাদের কম লাভ হচ্ছে। এখানকার তৈরি পরচুলা দেশের বিভিন্ন মার্কেটে ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এ এলাকায় পরচুলা তৈরির কারখানা হওয়ায় নারীদের কর্মসংস্থানে সৃষ্টি হয়েছে।

নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, পরচুলা শিল্পের কাজের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে কর্মক্ষেত্রে তৈরি করে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্রদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা এবং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির (নাসিব) নীলফামারী জেলার সভাপতি আব্দুল মোমিন বলেন, নীলফামারী জেলায় প্রায় ৫ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তা আছে। আর যেসব পরচুলা উদ্যোক্তা আছে তারা যদি যোগাযোগ রাখেন কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা চাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট উদ্যোক্তা তৈরি হোক। এক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই তাদের পাশে থাকবো। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আরএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।