অটিস্টিক শিশুদের আনন্দে রেখেছে ‘আনন্দধারা’
![অটিস্টিক শিশুদের আনন্দে রেখেছে ‘আনন্দধারা’](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/raj-1-20240126205127.jpg)
অটিস্টিক শিশুদের বোঝা মনে করে অনেক পরিবার। এমন শিশু ও তাদের মা-বাবার সঙ্গে মিশতে চান না সমাজের অনেকেই। এসব শিশুর মা-বাবা দিনের পর দিন তাদের গোপন কান্না ঢেকে রাখতে চেষ্টা করেন হাসির আড়ালে। এ ধরনের শিশুকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে ১৮ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন রাজশাহী নগরীর ওয়াহিদা খানম লিপি।
সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া ওয়াহিদা খানম লিপি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত। এরপরও অটিস্টিক দুই যমজ ছেলেকে নিয়ে সমাজে চলতে গিয়ে নানা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। এ উপলব্ধি থেকে তার মতো মায়েদের একটু স্বস্তি দিতে রাজশাহী নগরীর হেলেনাবাদ এলাকার নিজের চারতলা বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ফাউন্ডেশন ফর উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড অ্যাসিসট্যান্সের আওতায় ‘আনন্দধারা স্কুল’।
প্রতিষ্ঠানটিতে অটিস্টিক বাচ্চারা এখানে পড়াশোনা করছে। থেরাপি নিচ্ছে। ছবি আঁকছে। আবার কারখানায় কাজও করছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসছে। একজনের আঁকা ছবি এরইমধ্যে পুরস্কৃত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিও পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে বিশেষ পুরস্কার। তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের বেকারি পণ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা স্কুলের খাতা বাঁধাই করছে। পুঁথির মালা তৈরি করছে। প্রায় অর্ধশত অটিস্টিক ছেলেমেয়ে আনন্দময় রাজশাহীতে ‘আনন্দধারা’ পরিবেশে এ কাজ করছে। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক নিয়ে এসে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ১৮ বছর আগে রাজশাহী নগরের ভেড়িপাড়া রাজশাহী এলাকায় ওয়াহিদা খানম লিপি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কাজ করতে গিয়ে তার আনন্দধারা -১ ও আনন্দধারা নামের দুটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে।
ওয়াহিদা খানমের নিজের দুটি বাচ্চাই অটিস্টিক। তাদের নিয়ে নিজের উপলব্ধি থেকেই তিনি ২০০৫ সালের ‘প্রয়াস’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। তার মা নিজের বাসার বসার ঘরেই প্রয়াস চালু করার জন্য জায়গা ছেড়ে দেন। ওয়াহিদা খানম তার নিজের বাচ্চার ফিজিওথেরাপির শিক্ষককে স্কুলের বাচ্চাদের থেরাপির কাজে লাগান। ধীরে ধীরে শিশু বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করার প্রয়োজন পড়ে। তখন ‘ফাউন্ডেশন ফর উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড অ্যাসিসট্যান্স’ নাম দিয়ে নিবন্ধন করা হয়। প্রয়াসকে তার একটি প্রকল্প হিসেবে দেখানো হয়। ২০১৪ সালে এর নাম দেওয়া হয় ‘আনন্দধারা’। এখান থেকে অনেক বাচ্চাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কোনো বাচ্চাকে আবার ফিরিয়ে নিতে হয়েছে।
ওয়াহিদা খানম বলেন, এসব বাচ্চাদের কীভাবে কর্মমুখী করা যায় সেই চিন্তা থেকেই তিনি নগরের ভাটাপাড়া এলাকায় ‘আনন্দধারা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এখানে তারা বিভিন্ন ধরনের কেক, চিকেন বান, কোকোনাট বান পেটিস, পাঁচ ধরনের বিস্কুট, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পুঁতির মালা, কাগজের ঠোঙা তৈরি করছে। রাজশাহী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে তাদের একটি দোকান রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন তাদের তৈরি পণ্য ফরমায়েশ দিয়ে নিয়ে থাকে। আট বছর হলো উৎপাদনে গেছে তারা।
এ কাজ মোটেও সহজ ছিল না জানিয়ে ওয়াহিদা খানম বলেন, ‘কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। বেসরকারি সংস্থা মাইডাস তাদের নেদারল্যান্ডস থেকে ফিজিওথেরাপিস্ট ও বেকারির প্রশিক্ষক দিয়ে সহযোগিতা করেছে।’
‘অটিস্টিক বাচ্চার মায়েরা দুঃখ করে বলেন, আমি মারা গেলে আমার বাচ্চাটার কী হবে! এ মায়েদের কষ্ট আমি অনুভব করি। আমি চাই এ প্রতিষ্ঠানে অটিস্টিক বাচ্চারা পুনর্বাসিত হবে। মায়েরা দেখে যাবেন, তার সন্তানেরা অন্যের বোঝা নয়, বরং তারা নিজেরা উপার্জন করছে। তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে’, যোগ করেন ওয়াহিদা খানম লিপি।
‘আনন্দধারা’ থেকে প্রায়ই খাবার কেনেন আইন সহায়তা সংস্থা ব্লাস্টের রাজশাহীর সমন্বয়কারী সামিনা বেগম। তিনি বলেন, তাদের পণ্যের মান ভালো।
সংগঠনের দলনেতার দায়িত্বে রয়েছেন সাদিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণ দিয়ে ওদের যাকে কাজটি ধরিয়ে দেওয়া হয়, আমরা ভুল করলেও তারা কোনো ভুল করে না। তারা সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে করে।’
প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা গেছে, সবাই কাজে ব্যস্ত। তিনটি কক্ষ নিয়ে কারখানাটি। এক পাশের পক্ষে নিপা, বর্ষা, সুলতানা নামের তিনজনকে পেটিস তৈরি করতে দেখা যায়। তারা কাজে এতটাই নিবিষ্ট ছিল যে, কেউ কারো সঙ্গে কথাও বলছে না।
আরেকটি কক্ষে খাতা বাঁধায়ের কাজ করছেন কয়েকজ। একজন আরেকজনকে বলছে, ‘দেখলে হবে? কাজ করো। আজকে আমাদের কাজ সবার আগে শেষ করতে হবে’।
বাকি কক্ষটিতে পুঁথির মালা বুনছিল কয়েকজন। তবে তারা চুপচাপ। কিছুটা ধীরে ধীরে হচ্ছে এ কাজ। তাদেরই একজন বলে, ‘একটি মালা বানাতে তিন দিন লাগবে।’
এসআর/এএসএম