ফার্নেস অয়েল নিয়ে বেকায়দায় বিপিসি

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৮:২০ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫

আলেজ সংকটের আশঙ্কা, বন্ধের হুমকিতে ইস্টার্ন রিফাইনারি

তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাধারণত জ্বালানি আমদানি করে নিজেরা। অনেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মাধ্যমে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে তেল নেয়। পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী আমদানির মাধ্যমে তরল জ্বালানি সরবরাহ করে বিপিসি।

বর্তমানে চাহিদামাফিক ফার্নেস অয়েল নিচ্ছে না পিডিবি। এতে বেকায়দায় পড়ছে বিপিসি। তৈরি হয়েছে আলেজ (জ্বালানি তেল ধারণ সক্ষমতা) সংকটের আশঙ্কা। সংকট এড়াতে বিপিসি গত দুই মাস ফার্নেস অয়েল আমদানি বন্ধ রাখে। তবে ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদন স্বাভাবিক থাকায় ধীরে ধীরে ফার্নেস অয়েলের মজুত বাড়লেও আলেজ সংকটে ইস্টার্ন রিফাইনারি বন্ধের হুমকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিপিসি। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসের ৩৫ হাজার টন সংশোধিত চাহিদার বিপরীতে ১৪ দিনে মাত্র দুই হাজার ৯৬০ টন ফার্নেস অয়েল নিয়েছে পিডিবি।

এ বিষয়ে পিডিবি বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় তরল জ্বালানি। একদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় পিডিবি, অন্যদিকে বেসরকারি আইপিপিগুলোর (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) বকেয়া পাওনা নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। এতে আইপিপিগুলোতে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে চাহিদা থাকলেও বিপিসি থেকে চাহিদা দেওয়া তরল জ্বালানি সরবরাহ নিতে ব্যর্থ হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

আরও পড়ুন
অভিজ্ঞতা নেই, তবুও ১৫ বছর এসপিএম অপারেশনে আগ্রহী শিপিং করপোরেশন
কুমিল্লায় দেশের প্রথম স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি বিপণন ডিপো বিপিসির
বেসরকারি প্ল্যান্টের তেল কিনে ৩ মাসে বিপিসির ‘গচ্চা’ ২৮ কোটি টাকা
পাইপলাইন থেকে যমুনার পৌনে ৪ লাখ লিটার ডিজেল গেলো কোথায়

তথ্য অনুযায়ী, বিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) মূল স্থাপনা ও ডিপোগুলোতে বর্তমানে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৫৫ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল মজুতের সক্ষমতা রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর ফার্নেস অয়েলের মজুত ছিল ৯৪ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৫২ হাজার টন স্টোরেজ সক্ষমতার মধ্যে ৪৩ হাজার ২৭৫ টন, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এসএওসিএলের পতেঙ্গা প্রধান ডিপোতে ৩৩ হাজার ১ টন স্টোরেজ সক্ষমতার মধ্যে ২৭ হাজার ৮৪৮ টন, মংলায় ৭ হাজার ৩২০ টনের মধ্যে ১ হাজার ৪২৭ টন ফার্নেস অয়েল রয়েছে।

পাশাপাশি গোদনাইল ডিপোতে ৫ হাজার ১৩৭ টনের মধ্যে ৪ হাজার ১১৯ টন, তাছাড়া অয়েল ট্যাংকারযোগে ওই ডিপোতে যাওয়ার পথে রয়েছে ২ হাজার ৯০৭ টন ফার্নেস অয়েল। ফতুল্লা ডিপোতে ফার্নেস অয়েল রাখার ট্যাংক না থাকলেও ডিপোর সার্ভিস ট্যাংকে রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৭ টন। অন্যদিকে, দৌলতপুর ডিপোতে ১০ হাজার ৪৯৭ টন স্টোরেজ সক্ষমতার মধ্যে ১০ হাজার ৪৭১ টন ফার্নেস অয়েল রয়েছে।

আমরা বিদ্যুতের লোড ডিমান্ডগুলোর পূর্বাভাস নিই। পূর্বাভাস ও সাপ্লাই চেইনগুলোর সবই সঠিকভাবে সচল থাকলে তেল সরবরাহ নিতে কোনো জটিলতা হয় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরগুলো মেলে না।- পিডিবির উপ-সচিব (উৎপাদন) মো. হেলালুর রহমান

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোদনাইল ডিপো থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল সরবরাহ না নিলে চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া ট্যাংকারকে বসিয়ে রাখতে হবে। এজন্য ট্যাংকার দুটিকে ভাড়ার পাশাপাশি গুনতে হবে ডেমারেজ। আবার দৌলতপুর ডিপোতে আর কোনো আলেজ নেই।

বিপিসি বলছে, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিদেশি সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করতে হয় আগে থেকেই। ছয় মাসের একটি আমদানি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এজন্য পিডিবি থেকেও আগেভাগে দেওয়া হয় তরল জ্বালানির চাহিদা। ২০২৫ সালের জন্য ১২ লাখ ৩৯ হাজার ২৩১ টন ফার্নেসের চাহিদা দেয় পিডিবি। কিন্তু প্রথম চার মাসে চাহিদামাফিক তেল সরবরাহ না নেওয়ায় গত ২২ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে একটি চিঠি দিয়েছে বিপিসি।

এতে বলা হয়, জাহাজ থেকে তেল খালাসে দেরির কারণে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। এটি এড়াতে এপ্রিলের অবশিষ্ট কয়েক দিনের মধ্যে ৪০ হাজার টন ও মে মাসে একলাখ টন ফার্নেস অয়েল গ্রহণে পিডিবিকে নির্দেশ দিতে অনুরোধ করা হলো।

পাশাপাশি গত ১৫ মে পিডিবিকে আরেকটি চিঠি দেয় বিপিসি। তাতেও চাহিদামাফিক তেল সরবরাহ না নেওয়ায় বিপিসিকে আলেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে বলে জানানো হয়। এজন্য আমদানি করা জ্বালানি তেলের জাহাজ বসিয়ে রেখে ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে। এ ডেমারেজের অংশ পিডিবিকেও বহন করতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এরপর গত ২২ মে ২০২৫ সালের শেষ ছয় মাসের (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) জন্য তিন লাখ ১৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের সংশোধিত চাহিদা দেয় পিডিবি।

বিপিসি বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত) ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭৪ টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদার বিপরীতে পিডিবি নিয়েছে তিন লাখ ৭৬ হাজার ৫৬৪ টন। তবে শেষ ছয় মাসের সংশোধিত চাহিদা দিলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাসে চাহিদার চেয়ে ২৫ হাজার টন বেশি নিয়েছে পিডিবি। আবার নভেম্বর মাসে ৪৫ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে নিয়েছে ২৯ হাজার ৮১৮ টন এবং ডিসেম্বর মাসের ৩৫ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে প্রথম ১৪ দিনে নিয়েছে মাত্র দুই হাজার ৯৬০ টন।

বিপিসির তথ্য মতে, ফার্নেস অয়েল রাখার মতো বিপিসিতে সবমিলিয়ে আলেজ রয়েছে ১৩ হাজার টনের মতো। কিন্তু ইআরএল দৈনিক গড়ে এক হাজার ১০০ টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করে। তাতে চলতি মাসের ১৪ দিনে পিডিবির ফার্নেস অয়েল সরবরাহ নেওয়ার চিত্র অনুযায়ী আগামী ১২-১৫ দিনের মধ্যে ইআরএলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে অন্য প্রোডাক্টগুলোর সরবরাহ চেইনে প্রভাব তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিপিসি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিডিবি বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও চাহিদামাফিক তেল সরবরাহ নেয়নি। অথচ দেশের চাহিদার প্রায় ৯২ শতাংশ আমদানি করতে হয়। জ্বালানি তেল চাইলেই আমদানি করা যায় না। এজন্য ছয় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ছয় মাস আগেই সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে। আবার পুরো বছরের একটি শিডিউল আগেভাগে তৈরি করতে হয়।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পিডিবি যে চাহিদা দেয়, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা তেল আমদানির শিডিউল তৈরি করি। কিন্তু চাহিদামাফিক সরবরাহ না নিলে তেল নিয়ে আসা জাহাজকে বসিয়ে রেখে বিপিসিকে জরিমানা গুনতে হয়। এ বছরের প্রথম চার মাসে চাহিদার অর্ধেক নেওয়ায় আলেজ নিয়ে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়। এজন্য পিডিবিকে কড়া ভাষায় চিঠি দিতে হয়েছে। পরে পিডিবি শেষ ছয় মাসের জন্য সংশোধিত চাহিদাপত্র দিয়েছে। সেই সংশোধিত চাহিদাও মানছে না পিডিবি।’

পিডিবি যেহেতু স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিচ্ছে না, সেজন্য গত দুই মাসে আমরা পার্সেল (আমদানি চালান) আনিনি। এখন ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকেই শুধু ফার্নেস অয়েল আসছে। পিডিবিও সরকারি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে বিপিসি থেকে সময় অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।- বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান

এখন ফার্নেস অয়েলের আলেজ কমে আসছে। আলেজ সংকট হলে ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হতে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

পিডিবির উপ-সচিব (উৎপাদন) মো. হেলালুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকগুলো ফ্যাক্টর মিলিয়ে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে চাহিদাপত্রটা দেওয়া হয়। আমরা বিদ্যুতের লোড ডিমান্ডগুলোর পূর্বাভাস নিই। পূর্বাভাস ও সাপ্লাই চেইনগুলোর সবই সঠিকভাবে সচল থাকলে তেল সরবরাহ নিতে কোনো জটিলতা হয় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরগুলো মেলে না।’

বিদ্যুৎ আমদানির কারণে দেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তরল জ্বালানি হচ্ছে আমাদের (পিডিবি) সবশেষ পছন্দ। আমাদের অন্য উৎসগুলো থেকে লোড পূরণ করা না গেলেই আমরা তরল জ্বালানির দিকে যাই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইপিপিগুলোতে অনেক টাকা বকেয়া পড়েছে। সঠিকভাবে অর্থ পরিশোধ করা গেলে, তাদের প্ল্যান্টগুলোও সঠিকভাবে চলে। তাহলে চাহিদামাফিক ফুয়েল তারা নিতে পারে। মূলত প্ল্যান্টগুলোর চাহিদা নিয়েই তো আমরা বিপিসিকে চাহিদা দেই।’

এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিডিবি যেহেতু স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিচ্ছে না, সেজন্য গত দুই মাসে আমরা পার্সেল (আমদানি চালান) আনিনি। এখন ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকেই শুধু ফার্নেস অয়েল আসছে। পিডিবিও সরকারি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে বিপিসি থেকে সময় অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।