করোনা : এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরামর্শ আবুল বারকাতের

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৮ পিএম, ০৪ এপ্রিল ২০২০
ফাইল ছবি

করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালানোর পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। এই অর্থ কিভাবে আসবে সে বিষয়েও ধারণা দিয়েছেন তিনি।

তার মতে, এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও সম্পূর্ণ অর্থ একই সঙ্গে এখনই প্রয়োজন হবে না। কারণ বেশ কিছু জিনিসপত্র যেমন রি-এজেন্ট, বেতন-ভাতা, পরিবহন ব্যয়– এসব সামনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লাগবে।

এই এক লাখ কোটি টাকা কিভাবে আসবে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার জানা মতে বৈশ্বিকভাবে করোন মোকাবিলায় ইতিমধ্যে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা আক্রান্ত দেশগুলো ব্যবহার করবে। আর পাশাপাশি এ বাবদ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট ও চ্যারিটি সংস্থা।

অর্থাৎ এ মুহূর্তে করোনা প্রতিরোধে বৈশ্বিক তহবিলে আছে কমপক্ষে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এ অঙ্ক বাড়বে)। যৌক্তিক কারণেই বৈশ্বিক জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের ন্যায্য হিস্যা হওয়া উচিত ওই ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কমপক্ষে তিন শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের পাওনা হতে পারে কমপক্ষে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

এ হিস্যা পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, এটি পেতে হলে প্রয়োজন হবে শক্তিশালী অতি জরুরি ফলপ্রসূ কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ ক্ষেত্রেও ভ্যানগার্ড হতে পারেন বিশ্ব সমাজে আদৃত আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক তহবিল থেকে ওই অর্থ পাওয়া গেলে ঘাটতি থাকবে ৮৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

ঘাটতি পূরণের উপায় হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঘাটতি অর্থ পূরণের উৎস হতে পারে জরুরি অবস্থায় সম্পদশালীদের ওপর কর অর্থাৎ ওয়েলথ ট্যাক্স আরোপ (৩০ হাজার কোটি টাকা), পাচারকৃত অর্থ ও কালো টাকা উদ্ধার (৬০ হাজার কোটি টাকা)। এখানে অর্থনীতি শাস্ত্রের কয়েকটি প্রমাণিত-পরীক্ষিত সত্য কথা উল্লেখ জরুরি- ওয়েলথ ট্যাক্স বৈষম্য হ্রাস করে, অর্থ পাচার ও কালো টাকা বৈষম্য বাড়ায়, সম্পদশালীদের ওপর ট্যাক্স কমালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে না, সমাজের নীচ তলার ৯০ শতাংশ মানুষের ওপর কর কমালে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে।

তার মতে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগের ফল হবে বহুমুখী পজিটিভ–স্বল্প ও দীর্ঘ উভয় মেয়াদেই। স্বল্প মেয়াদে আক্রান্ত মানুষ বাঁচবে, সংক্রমণ হার কমবে, সংক্রমণ বিস্তার রোধ হবে, কমিউনিটিতে ছড়িয়ে যাওয়া কমবে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে, মানুষের মানসিক দুশ্চিন্তা দুর্দশা কমবে, কো-মর্বিডিটি (সহ অসুস্থতা) কমবে একই সঙ্গে কমবে মৃত্যুর হার।

আর দীর্ঘ মেয়াদে লাভ হবে অনেক সুদূরপ্রসারী, ভাইরাস প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। সমগ্র স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী আমাদের অবস্থান বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১১৩তম, যেখানে প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট সূচক জীবাণু বাহিত অসুখ-বিসুখ, বায়ো-সিকিউরিটি, বায়ো-সেফটি, জীবাণু কন্ট্রোল প্রাকটিস ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্য সিস্টেম, র‌্যাপিড রেসপনস, রোগ নির্ণয় ও রিপোটিং–এসব সূচকে আমাদের অবস্থান বেশ তলার দিকে।

তার মতে, এক লাখ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে উন্নততর করবে যার অভিঘাত হবে কল্পনাতীত পজিটিভ এবং বংশপরম্পরা। নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি বলয় দৃঢ়তর হবার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জনস্বাস্থ্যসহ অর্থনৈতিক-সামাজিক বলয় সুসংহত হবে। দৃঢ়তর হবে সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যা সুশাসনের পূর্বশর্ত। দুর্বল প্রতিষ্ঠান সবল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে যা টেকসই প্রবৃদ্ধি ও প্রগতি নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত।

‘ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বাস্থ্যের জন্য এ বিনিয়োগ হবে ওপরি পাওনা অর্থাৎ তখন তাদের এ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন পড়বে না। শুধু রক্ষণাবেক্ষণসহ প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। এ বিনিয়োগ সুস্থ মানব সমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি সুপ্রশস্থ করবে যা ভবিষ্যতে জন-সমৃদ্ধি ও মানবকুশলতা নিশ্চিত করবে। এক কথায় এ হল সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানের আবশ্যিক বিনিয়োগ।’

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যা করতে হবে

পিসিআর বা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন ম্যাসিনে মলিকুলার ডায়াগনোসিসের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রি-এজেন্ট যেন প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার টেস্ট করা সম্ভব হয় (এ মুহূর্তে আমাদের দেশের তুলনায় অর্ধেক জনসংখ্যার দেশ জার্মানিতে প্রতিদিন টেস্ট হচ্ছে ৭০ হাজার), দ্রুত বা র‌্যাপিড টেস্টের জন্য কমপক্ষে দুই লক্ষ রোগ নির্ণয় কিট– যে কিটের কার্যকারিতা ইতিমধ্যে শতভাগ প্রমাণিত (অর্থাৎ পরীক্ষামূলক কোনো কিট নয়), সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, ল্যাব-বিজ্ঞানী ও জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান-কর্মীবাহিনী নিয়োগ, নির্ণীত রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ভেনটিলেটর, অক্সিজেন এবং গুরুতর রোগীর জন্য ডেডিকেটেড ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ ব্যবস্থা, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রোগীর লালা-রক্ত ইত্যাদি বহনের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কোল্ড চেইন ব্যবস্থা, দেশের ভেতরেই সংশ্লিষ্ট যেসব উপাদান-উপকরণ আছে তার পূর্ণ ইনভেনটরি, রোগতত্ত্বীয় ও সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের ডাটা বেইজ প্রতিষ্ঠা ও তা সংরক্ষণের ত্রুটিহীন নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা, হাসপাতাল-চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীদের প্রবেশ এবং বেরুনোর জন্য রোগের ধরন অনুযায়ী (যাকে বলা হচ্ছে ওয়ান ওয়ে ইন অ্যান্ড আউট) সংক্রমিত রোগী, সংক্রমণ-সম্ভাব্য রোগী, অসংক্রমিত রোগীর প্রবেশের জন্য তিনটি ভিন্ন পথ আর বেরুনোর সময় সংক্রমিত রোগী ও অসংক্রমিত রোগীর জন্য দুটি ভিন্ন পথ, মানব স্বাস্থ্য, জীবজন্তু ও পরিবেশ স্বাস্থ্যের ডাটা ইন্টিগ্রেশনের ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে জননিরাপত্তা ব্যবস্থার সংযোগ স্থাপন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য পরীক্ষিত নিরাপত্তা পরিধেয় এবং প্রণোদনা ব্যবস্থা, কার্যকর সঙ্গরোধ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিধি যে কোনো মূল্যে কঠোরভাবে পালনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, সামাজিক মেলামেশা রোধ, ভাইরাস প্রতিরোধী সামাজিক আন্দোলন জোরদার, বিদেশ থেকে রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ-ডাক্তার-নার্স আনা, অসংক্রমিত রোগ যেমন ক্যানসার, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস–যেসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে দেশে প্রতিবছর ৫০ লক্ষ অদরিদ্র মানুষ দরিদ্রদের কাতারে যুক্ত হচ্ছেন– এসব রোগের চিকিৎসা চালু রাখা, চালু রাখা গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুর চিকিৎসা সেবা, গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখা যে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের কো-মরবিডিটি অর্থাৎ অন্য রোগে আক্রান্ত মানুষ যদি করোনার কবলে পড়েন সে ক্ষেত্রে তার মৃত্যু সম্ভাবনা অথবা গুরুতর অসুস্থ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা সাজানো। এক কথায় দরকার হলো সমগ্র স্বাস্থ্য সেক্টর ও জনস্বাস্থ্য সেক্টরকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া ও সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা।

এমএএস/এএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।