শেয়ারবাজারে লেনদেন চালুর পরিবেশ নেই
মহামারি করোনাভাইরাসের থাবায় স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বের জনজীবন ও অর্থনীতি। দিন যত যাচ্ছে করোনার প্রকোপ তত বাড়ছে। সামনে মহাদুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ পরিস্থিতিতেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেন চলমান রয়েছে। তবে করোনার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার।
যে কারণে ২৫ এপ্রিলের পর সরকারের সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়লে ২৬ মার্চ থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার দাবি উঠেছে। তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের বড় অংশ এবং কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে শেয়ারেবাজারে লেনদেন চালানোর মতো অবস্থা নেই। যতদিন সরকারের সাধারণ ছুটি থাকবে ততদিন শেয়ারবাজারে লেনদেন করা সম্ভব হবে না বলে অভিমত তাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে অটোমেটেড লেনদেন চালু থাকলেও তা শুধু ট্রেডিং ও সার্ভিল্যান্সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। লেনদেন সম্পন্ন করতে ব্রোকারেজ হাউসের ওয়ার্ক স্টেশন পরিচালনার জন্য এখনও ব্যক্তির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। কাউকে না কাউকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এটি চালু রাখতে হবে।
সূত্রটি বলছে, ব্রোকারেজ হাউসের কার্যালয় বা শাখার জন্য যে ওয়ার্ক স্টেশন নির্ধারিত রয়েছে, তা অন্যত্র সরিয়ে নিতে বা পরিচালনা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। শেয়ার কেনা-বেচার পর সেটেলমেন্ট সম্পন্ন করতে ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে কি-না তা নিশ্চিত হতে হয়। এটিও করতে হয় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। আবার স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসের তথ্য আদান-প্রদানও হয় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। ফলে সাধারণ ছুটিরে মধ্যে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালানো সম্ভব না।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়ার পর এর প্রকোপ সামাল দিতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। চার দফা এই ছুটি বাড়িয়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে।
সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর পরই শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। ফলে ২৫ মার্চের পর শেয়ারবাজারে আর লেনদেন হয়নি। এ পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ থেকে দাবি জানানো হচ্ছে, সাধারণ ছুটি বাড়লেও আগামী ২৬ এপ্রিল থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করা উচিত। এ পক্ষের সঙ্গে একমত ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমানও।
এ বিষয়ে রকিবুর রহমান বলেন, ‘যদি সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়েও আগামী ২৬ এপ্রিল পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করা উচিত। কারণ বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের অন্য পুঁজিবাজারগুলো থেকে আমাদের বাজার আলাদা থাকতে পারে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি ভুল বার্তা দিচ্ছে। তাছাড়া মানবিক কারণে হলেও পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করা জরুরি।’
ডিএসইর এই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বলেন, ‘অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আছেন, যাদের জীবনের সব সঞ্চয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা আছে। বর্তমানে সাধারণ ছুটিতে সবকিছু বন্ধ থাকায় তাদের অনেকেরই আয়-রোজগার নেই। তাদের হয়তো জরুরি টাকা দরকার। কারণ অর্থনীতির আগে বেঁচে থাকা জরুরি। কিন্তু লেনদেন বন্ধ থাকায় তারা তাদের বিনিয়োগ থেকে কোনো টাকা তুলে নিতে পারছেন না। লেনদেন চালু হলে তারা তাদের এই সঙ্কট একটু সহজে মোকাবিলা করতে পারবেন।’
তবে ডিএসইর এই পরিচলকের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অন্য শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা। এমনকি ডিএসইর কর্মকর্তারাও সাধারণ ছুটির মধ্যে লেনদেন চালু করা সম্ভব না বলে মনে করছেন। তবে তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু সাধারণ ছুটির মধ্যে লেনদেন চালু রাখার কোনো পরিবেশ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চাই শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হোক। এতদিন শেয়ারবজার বন্ধ থাকা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। কিন্তু দুঃখ্যজনক হলেও সত্য এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার মতো পরিস্থিতি নেই। সুতরাং যতদিন সরকারের সাধারণ ছুটি থাকবে ততদিন শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করা সম্ভব হবে না।’
ডিএসইর আরেক শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। শেয়ারবাজার বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রনায় আছে ব্রোকাররা। আমরা মনে-প্রাণে চাই লেনদেন চালু হোক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের লেনদেন চালু রাখার মতো সক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। কারণ লেনদেন চালু করতে মেইন কম্পিউটারটা (ম্যাচিং কম্পিউটার) পরিচালনা করতেই ২০-২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী লাগে, যাদেরকে সশরীরে উপস্থিত হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে এটা কীভাবে সম্ভব?’
তিনি বলেন, ‘ম্যাচিং কম্পিউটার ছাড়াও লেনদেন কার্যক্রম চালাতে প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউসে লোকবলের দরকার। সরকারি ছুটির কারণে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এদের এখন কীভাবে ফিরিয়ে আনব? সুতরাং এই পরিস্থিতিতে লেনদেন চালু করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আগে মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে, তারপর ব্যবসা।’
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজর চালু রাখা হলেও আমাদের বাজারে তা সম্ভব না। অন্য দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান একক সত্ত্বা হলেও আমাদের এখানে ভিন্ন। বাংলাদেশে বিএসইসির ওপর আইনি বিষয়গুলো এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) ওপর লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয় নির্ভর করে। ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শেয়ারবাজার খোলা রাখা সম্ভব না।
ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে যাই বলুক, সাধারণ ছুটির মধ্যে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালানো সম্ভব না। কারণ আমাদের শেয়ারবাজারে তথ্যপ্রযুক্তি সেইভাবে ডেভেলপ করেনি। কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনের শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়াম চুক্তির সময় বেশকিছু কারিগরি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যার মূল্য উল্লেখ করা হয় ৩০৮ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো গত দেড় বছরে তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। অটোমেটেড বলা হলেও আমাদের শেয়ারবাজার প্রকৃত পক্ষে অটোমেটেড না।’
এমএএস/এসআর/পিআর