করোনার অভিঘাতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে বাজেট

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:২৬ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২০

>> নির্ধারিত সময়েই বাজেট ঘোষণা করতে চান অর্থমন্ত্রী
>> আসতে পারে তিন মাসের অস্থায়ী বাজেটও
>> আকার হতে পারে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা
>> বরাদ্দ বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মরণ কামড়ে থমকে গেছে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পুরো বিশ্ব পড়েছে আর্থিক মন্দার কিনারে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। করোনার সংক্রমণরোধে সারাদেশ রয়েছে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস আদালত বন্ধ। বন্ধ সব ধরনের গণপরিবহনও। বন্ধ দোকান-পাট, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

এতে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতিতে পড়েছে দেশ। এর ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলতে পারছেন না খোদ অর্থমন্ত্রী। এ অবস্থার মধ্যেই চলতি বাজেটের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। সংবিধান অনুযায়ী আসছে জুন মাসেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে হবে। তাই কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও সাধারণ ছুটি উপেক্ষা করে বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বাজেট প্রণয়নের কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ নির্ধারিত সময়েই বাজেট ঘোষণা করতে চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর করোনার অভিঘাতকে গুরুত্ব দিয়েই দ্রুতগতিতে প্রস্তুত হচ্ছে আগামী বাজেট।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নে কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ে তথা আগামী জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার (৪ জুন) বা দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার (১১ জুন) ঘোষণার লক্ষ্য নিয়েই বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে।’

বাজেট প্রণয়েনের সাথে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে অর্থমন্ত্রীর বিকল্প পরিকল্পনাও রয়েছে। সেটি হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী তিন মাসের একটি অস্থায়ী বাজেট ঘোষণা হতে পারে। এ অস্থায়ী বাজেট চলাকালীন অর্থমন্ত্রী পুনরায় পুরো অর্থবছরের বাজেট ঠিক করবেন। তিন মাস পর পুনরায় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী।’

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ছয় লাখ কোটি কিংবা তারও বেশি টাকার আগামী বাজেট ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। কিন্তু করোনার কারণে সেটি কমিয়ে ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ তথা এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ার আগেই বেশ মন্দাভাব ছিল রাজস্ব আহরণে। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে। এ অবস্থার মধ্যেই আসে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মরণ কামড়। তাই এ ঘাটতি অর্থবছরে শেষে অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেজন্য আগামী বাজেটেও ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রভাবে দেশে আরও নতুন করে অনেক বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগামীতে এদের সহায়তার আওতায় আনতে আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে।

আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতাও বাড়ানো হবে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৯ লাখ গরিব মানুষ।

এদিকে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) করোনাভাইরাসকে মানব ইতিহাসের ভয়াবহ সঙ্কট হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি, স্বাস্থ্য খাত, পর্যটন, প্রবাসী আয়, রাজস্ব, অনানুষ্ঠানিক খাত, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সব শেষে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি, অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে রাজস্ব আহরণ ও সরকারি ব্যয় এবং খাতভিত্তিক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোভিড-১৯ এর ফলে যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।

তিনি বলেন, বর্তমান প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এমনিতেই ২০১৯ অর্থবছরে মোট রাজস্ব ঘাটতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকা হবে বলে অনুমিত হয়, আর এর সঙ্গে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে অতিরিক্ত অর্থের যোগ করলে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অবশ্য করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব ও তা থেকে উত্তরণে আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি- এ চারটি কার্যক্রম নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে সরকার।

আগামী বাজেটে কোন খাতে গুরুত্ব দেয়া বেশি প্রয়োজন, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আগামী বাজেটকে সাধারণভাবে চিন্তা করলে চলবে না। বর্তমানে একটা জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। তাই বাজেটে চলমান কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে সে অর্থ দিয়ে মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তার বিষয়ে জোর দিতে হবে।

অন্যদিকে আগামী বাজেটের নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নের কাজও এগিয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এবং অর্থনীতিতে এর অভিঘাতের কথা মাথায় রেখেই তৈরি হচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপি। সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কৃষি খাতেও। আর নতুন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তি কিংবা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিকে।

প্রতিবছর জুন মাসে বাজেট ঘোষণার আগেই মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে নতুন অর্থবছরের এডিপি অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। সে কারণে মার্চ নাগাদ শুরু হয়ে যায় এডিপি তৈরির কাজ। এ বছরও মার্চ মাসেই শুরু হয়েছে এডিপি প্রণয়নের কাজ। ২৩ মার্চ জারি করা হয়েছে এডিপি প্রণয়নের নির্দেশিকা। এরপর করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও থেমে নেই এর কাজ। গত বুধবারও (১৫ এপ্রিল) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এডিপিতে নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তি এবং এডিপিতে প্রকল্পভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রস্তুতির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, এরই মধ্যে জারি করা এডিপির নীতিমালায় বলা হয়েছে- নতুন প্রকল্প যুক্ত করার ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র্য নিরসনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়ন, এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জন, নদীভাঙন-জলাবদ্ধতা রোধে ড্রেজিং, নদীশাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সমন্বিত প্রকল্প প্রণয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এমইউএইচ/এইচএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।