করোনায় ছন্দপতন বহু সংসারে
দুই সন্তানের জনক কামরুল। পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। গুলিস্তানের একটি দোকানে মোবাইল সার্ভিসিং করে প্রতি মাসে আয় হতো ২০-২৫ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়েই টেনেটুনে চলছিল পরিবারের চার সদস্যের ভরণ-পোষণসহ অন্যান্য খরচ।
তবে মহামারি করোনাভাইরাসে বন্ধ হয়েছে কামরুলের আয়ের পথ। গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ তার মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান। স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে ভ্যানে ফল বিক্রি শুরু করেছেন এই যুবক।
সারাদিন ভ্যানে ফল বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। মহামারি করোনার মধ্যে সারাদিন ফেরি করে ফল বিক্রি করে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করাও অত্যন্ত দুরূহ। অথচ মাসে দুই রুমের একটি বাসার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৮ হাজার টাকা। ফলে মাসে যে আয় তার প্রায় পুরোটা দিতে হচ্ছে বাড়ির মালিককে। বাকি ২-৫ হাজার টাকা দিয়ে মেটাতে হচ্ছে সংসারের পুরো মাসের খরচ। যে কারণে বাধ্য হয়েই এক বেলা খেয়ে রোজা রাখছেন এই লড়াকু যুবক।
রোববার সকালে রামপুরায় ফল বিক্রির একপর্যায়ে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। কথায় কথায় জানান, যাত্রাবাড়ীর যে অঞ্চলে থাকেন সেখানে অনেক পরিচিত মানুষ আছেন। সবাই জানেন তার ভালো আয়। সে কারণে এই মহামারির মধ্যে কারো কাছে হাত পাততে পারছেন না। আবার লজ্জায় নিজ এলাকায়ও ফলের ব্যবসা করতে পারছেন না। তাই বাসা থেকে দূরে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফেরি করে ফলের ব্যবসা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, দোকান খোলা থাকলে আয় নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। প্রতিদিনই অনেক কাজ আসে। কাজের কোনো অভাব হয় না। ফলে পরিবার নিয়ে ভালোই ছিলাম। দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জমানো টাকা দিয়ে দিন পনেরো চলেছি। কিন্তু দিনের পর দিন বসে থাকলে তো সংসার চলবে না। তাই বাধ্য হয়ে গোপনে এই পেশায় নেমেছি। তবে বাজারে সব ধরনের পণ্যের যে দাম, তাতে এই ব্যবসার আয় দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার মোবাইল সার্ভিসিং পেশায় ফিরে যাব।
শুধু কামরুল নন, মহামারি করোনাভাইরাস বিপাকে ফেলেছে রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশেরই জীবনযাত্রা। একদিকে আয় নেই, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আবার লোকলজ্জায় কারো কাছে সাহায্যও চাইতে পারছেন না। ফলে নানামুখী জটিলতায় পিষ্ট হচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।
একটি রিক্রুটিং এজেন্সিতে কাজ করেন মামুন। মহামারি করোনার কারণে বন্ধ অফিস, কাজও নেই। বেতন গেছে আটকে। যে জমানো টাকা ছিল তা দিয়েই চলেছেন প্রায় দেড় মাস। কিন্তু জমানো টাকাও যে শেষ হয়ে এসেছে। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তিন সন্তানের এই পিতা।
তিনি বলেন, অফিস না খোলা পর্যন্ত বেতন পাওয়ার আশা নেই। হাতে জমানো যে টাকা ছিল তা দিয়ে বড়জোর আর এক সপ্তাহের বাজার করা যাবে। অফিস না খুললে কী করব, সেই চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। বাজারে গিয়ে পণ্যের দাম শুনলে মাথা আরও গরম হয়ে যায়। একদিকে আয় নেই, অন্যদিকে সবকিছুর দাম বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা চলব কী করে? এই মুহূর্তে কারো কাছ থেকে ধার-দেনা করব তারও উপায় নেই। সবার-ই তো আমার মতো অবস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে তো হাত পেতে কারো কাছে সাহায্য চাওয়া সম্ভব নয়। আবার রিকশা চালানো বা সবজি বিক্রি করাও সম্ভব নয়। আমরা যে কী বিপদে আছি বলে বোঝাতে পারব না। এ অবস্থা চলতে থাকলে না খেয়ে ঘরের মধ্যে মরতে হবে।
চাকরিজীবী ও ছোট ব্যবসায়ীদের মতো কষ্টে রয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলোও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে বের হলেও আয় তেমন হচ্ছে না। অন্যদিকে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যের দাম চড়া। ফলে সমস্যায় জর্জরিত এ মানুষগুলোর কষ্ট আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা।
দুই সন্তানের পিতা রিকশাচালক মিঠু। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে সংসারের ঘানি টানছিলেন। সেই সঙ্গে স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। তাই দুই সন্তানকে স্কুলেও ভর্তি করেছেন। কিন্তু মহামারি করোনার ছোবলে তার সেই স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে।
মিঠু বলেন, আগে সারাদিন রিকশা চালিয়ে ৮০০-১২০০ টাকা আয় হতো। এখন ২০০-৩০০ টাকাও আয় হয় না। এই টাকা দিয়ে তো সংসার চালানো যায় না। মাসের ঘর ভাড়া দিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে চালের খরচই হয় না। এক মাসেরও বেশি হয়ে গেছে মাংস দিয়ে ভাত খাইনি। কয়েক দিন ধরে শুধু একবেলা খেয়ে রোজা থাকছি। একদিকে আয় নেই, অন্যদিকে জিনিপত্রের যে দাম তাতে আমাদের জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
নিত্যপণ্যের দাম
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, সরু চাল ৫৮-৬৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮-৫২ ও মোটা চাল ৩৮-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। খোলা আটা ২৮-৩২ ও প্যাকেট আটা ২৫-৪২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। লুজ সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯২-৯৩ টাকা। পাঁচ লিটার বোতলের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৪৮০-৫২০ টাকা। মসুরের ডাল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৯০-১৪০ টাকা। সবগুলো পণ্যের দাম করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে বেড়েছে।
এর সঙ্গে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনো মরিচ থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম করোনার মধ্যে বেড়েছে। আলু ২০-২৫ টাকা এবং পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৬০ টাকা। এছাড়া শুকনো মরিচ ২৫০-৩৫০ টাকা, আদা ১৫০-১৮০ টাকা, জিরা ৪৫০-৬০০ টাকা, গরুর মাংস ৫৮০-৬০০ টাকা, খাসির মাংস ৮০০-৯০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১২০-১৩০ টাকা, চিনি ৬৫-৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ২৬-২৮ টাকা।
এমএএস/এমএফ/এমএস