সুখে খেলাপিরা, ক্ষুধা-অভাবে আমানতকারীদের মানবেতর জীবন
অনিয়ম দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। ঋণের নামে লুট করেছে আমানতের টাকা। এখন খেলাপি হয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছেন তারা। অন্যদিকে জমানো অর্থ না পেয়ে ক্ষুধা, অভাব আর দুশ্চিন্তায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন আমানতকারীরা। চলমান করোনার প্রার্দুভাবে এখন জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি তারা। এমন দুরবস্থায় পড়েছেন অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএস) ব্যক্তি আমানতকারীরা।
আমানতকারীরা জানান, গত এক বছরের বেশি সময় আমানতের অর্থ না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। মুনাফার টাকায় যাদের সংসার চলত তাদের অবস্থা আরও খারাপ। আর চলমান করোনাভাইরাসের কারণে আমানতকারী অনেকে করুণ অবস্থায় দিন পার করছেন। চক্ষুলজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাততে পারছে না ফলে দু’বেলা ভাতও জুটছে না অনেকের। অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সুফল মিলছে না। আইন আর হাইকোর্ট দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এ অবস্থায় বিশেষ প্রণোদনা বা সাহায্য নয়, কষ্টে অর্জিত আমানতের টাকা ফেরত চাই- প্রধানমন্ত্রীয় কাছে এমন দাবি করছেন পিএলএফএস এর আমানতকারীরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে পিএলএফএস এর আমানতকারীরা লিখেছেন, ‘প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা দেশের মানুষের কল্যাণে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে জনগণকে বাঁচার জন্য প্রেরণা দিয়েছেন। সেখানে আমাদের আমানতকারীদের আমানত অতি সামান্য। এমতাবস্থায় আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন, আমাদের আমানতকৃত অর্থ ফিরে পাবার একটা সুব্যবস্থা করেন। আপনি অত্যন্ত দয়াবান ও অসহায়ের সহায়। করোনা মহামারির এই পরম ক্রান্তিলগ্নে আপনি দুর্গত সবাইকে সাহায্য করছেন, একইভাবে দয়া করে আমাদের দিকেও যদি আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাই আপনার কাছে আমাদের হাত জোড় মিনতি, আমাদের বাঁচতে সাহায্য করুন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুব জাগো নিউজকে জানান, দেড় বছরের বেশি সময় আমরা আমানতের অর্থ ফেরত পাচ্ছি না। আমাদের করুণ অবস্থা, দেখার কেউ নেই। অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গিয়েছি তারা আমাদের কোনো ব্যবস্থা করেনি। আমাদের জমানো টাকা ঋণের নামে লুট করেছে পরিচালকরা। তারা এখন খেলাপি হয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছে। আর আমরা আমানতকারীরা অর্থাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছি। আমাদের কী দোষ? করোনার কারণে আয় উপার্জন বন্ধ। এদিকে জমানো অর্থ আটকে আছে। আর বাচ্চার জন্য আমি একটা ডিমও কিনতে পারছি না। এ কষ্ট কিভাবে সই? প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই আবেদন, আমাদের বাঁচান। আমারা সাহায্য চাই না, আমাদের জমানো অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি পিপলস লিজিংয়ের বিষয়টি কোর্টে বিচারাধীন থাকায় কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ের গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে একনাবিন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে হাইকোর্টে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে হাইকোর্ট থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
এর আগে আমানত ফিরে পেতে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও দেখা করেছেন তারা। তাৎক্ষণিকভাবে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুফল পায়নি। আদৌ টাকা ফেরত পাবেন কিনা এ নিয়েও শঙ্কায় আছেন পিএলএফএসএল এর প্রায় ছয় হাজার ব্যক্তি আমানতকারী।
জানা গেছে, গত বছরের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিনই মামলার শুনানি শেষে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে পিপলস লিজিংয়ের নামে থাকা সব হিসাব ও অনিয়মের দায়ে বহিস্কৃত নয় পরিচালকের নামে থাকা শেয়ার ও তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া অবসায়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজনকে অবসায়ক নিয়োগের আদেশ দেন আদালত।
জানা যায়, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান খানকে অবসায়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা। এর বড় অংশই বের করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সামসুল আলামিন গ্রুপের নামে। গ্রুপের ২০ প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন পরিচালকের নামে অনিয়ম করে বের করা হয় ১৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পরিচালক মতিউর রহমান, খবির উদ্দিন, ইউসুফ ইসমাইল, বিশ্বজিত কুমার রায়ও নামে-বেনামে টাকা বের করে নেন। পিপলসের সাবেক চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রতিষ্ঠানটির ১২৩ কোটি টাকার জমি নিজের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে নিলেও পরে তা ছেড়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম বের হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি থেকে পরিচালক সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও খবির উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। আর চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন স্বেচ্ছায় পদ ছাড়েন।
প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় পিপলস লিজিংয়ের মোট আমানত ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। বাকি ৭০০ কোটি টাকা ৬ হাজার ব্যক্তি শ্রেণীর আমানত। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বড় অংশই নিয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
পিপলস লিজিংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালকরা সাধারণ আমানতকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ দায় এড়াতে পারে না। তাই অসহায় আমানতকারীদের কথা চিন্তা করে দ্রুত টাকা ফেরত দেয়ার দাবি জানান তারা।
জানা গেছে, আমানতের বিপরীতে কাগজ-কলমে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার সম্পদ দেখানো হলেও বাস্তবে তিন ভাগের এক ভাগও নেই বলে জানা গেছে।
এদিকে ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পায়। পরে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা পিপলস লিজিং ২০১৪ সাল থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না বিনেয়াগকারীদের। বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ রয়েছে।
এসআই/এমএফ/জেআইএম