সিএসআর বন্ধের সুপারিশ ‘আইন পরিপন্থী’

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৪২ পিএম, ১৮ জুন ২০২০

করোনাভাইরাস উদ্ভূত ‘অর্থনৈতিক মন্দা’ পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা উল্লেখ করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দেয়াসহ এক গুচ্ছ প্রস্তাবনা তৈরি করে তা সদস্যদের কাছে পাঠিয়েছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বা বিএবি। তাদের প্রস্তাবনার মধ্যে অন্যতম একটি হলো- সিএসআর, ডোনেশন ও চ্যারিটি বন্ধ রাখা। ব্যাংক খাতের মালিকদের এমন সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি আইনের পরিপন্থী। এ ধরনের সুপারিশ করা অনুচিত। এতে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করা হবে। এমন সিদ্ধান্ত যেন ব্যাংকগুলো বাস্তবায়ন না করে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা হবে, বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির এ সংকটে মানুষ অসহায় জীবন-যাপন করছে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় অনেকে মারা যাচ্ছেন। এখন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অতি জরুরি। এমন সময় উল্টো সিএসআর কার্যক্র‌ম বন্ধের সুপারিশ একেবারেই অনুচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিএসআর বন্ধ না করে ব্যাংকগুলোর উচিত হবে এ কার্যক্রমে অপব্যয় রোধ করা।

তারা বলছেন, অনেক ব্যাংক সিএসআরের নামে বড় বড় অনুষ্ঠান, র‌্যালি ও খেলাধুলার পেছনে অনেক টাকা খরচ করে। এখন এটি কমিয়ে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করা উচিত। এতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।

bank

ব্যাংকের ব্যয় কমাতে সম্প্রতি ১৩ দফা সুপারিশ করে বিএবির পক্ষ থে‌কে এ সংক্রান্ত চিঠি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের কাছে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা কমানো, পত্রিকা ও টেলিভিশনে সব প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখা এবং সিএসআর, ডোনেশন ও চ্যারিটি বন্ধ রাখা উল্লেখযোগ্য।

কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো এবং সিএসআর কার্যক্রম বন্ধের বিষয়টি ‘অনুচিত’ আখ্যা দিয়ে সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করবে— ঢালাওভাবে এটা বলা অনুচিত। এ ধরনের ঘোষণা দেয়া ঠিক নয়। সিএসআর বন্ধ না করে এ খাতের বিভিন্ন অহেতুক ব্যয় তারা কমাতে পারে। যেমন- বড় বড় প্রোগ্রামে অর্থায়ন, র‌্যালি করা, খেলাধুলার পেছনে ব্যয় করা— এমন ব্যয়গুলো তারা কমাতে পারে। তবে কোনোক্রমেই স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো খাতে সিএসআর বন্ধ করা যাবে না। কারণ সিএসআরের মূল্য উদ্দেশ্য হলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করা।

‘মহামারির এই সময়ে অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা করতে হবে। হয়তো ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাবে; আগের মতো সিএসআর ব্যয় করতে পারবে না। তবে যতটুকু ব্যয় করবে তা যেন সঠিক জায়গায় করা হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করা ঠিক হবে না।’

সাবেক গভর্নর আরও বলেন, খরচ কমাতে হলে বেতন কমাতে হবে কেন? সিএসআর বন্ধ করতে হবে কেন? এটি না করেও ব্যয় কমানোর আরও অনেক খাত রয়েছে। পরিচালকদের লভ্যাংশ, সভায় অংশগ্রহণের ফি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমাতে পারে। কিন্তু ঘোষণা দিয়ে এ ধরনের বিষয় চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়।

bank

সালেহউদ্দিন আহমেদ

বিএবির সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, সিএসআর কার্যক্রমের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। ব্যাংকগুলোকে এ নীতিমালা পরিপালন করতে হবে। এটি পালন না করা আইনের পরিপন্থী। ব্যাংকগুলো সিএসআর কার্যক্রম সঠিক নিয়মে করছে কি-না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করবে। যদি কোনো ব্যাংক নির্দেশনা অমান্য করে সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সর্বশেষ বুধবার (১৭ জুন) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্র‌মের আওতায় দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা উপকরণ ও সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে নির্ধারিত ব্যয়ের যে সীমা র‌য়ে‌ছে তা-ও নি‌শ্চিত করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের জনস্বাস্থ্যে উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে সিএসআর কর্মকাণ্ডের আওতায় স্বাস্থ্য খাতে নিয়মিত কার্যক্রম কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টস যেমন- পিসিআর, ভেন্টিলেটর মেশিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ক্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকসহ সকলের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরসনে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করার জন্য আপনাদের পরামর্শ প্রদান করা যাচ্ছে। এ সহযোগিতার আওতা জেলাপর্যায়ে বিস্তৃত করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে বলা হয়েছে সার্কুলারে।

সার্কুলারে আরও বলা হয়, বিদ্যমান নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের জনস্বাস্থ্যে উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় সিএসআর ব্যয়বণ্টনে স্বাস্থ্য খাতে ৬০ শতাংশ, শিক্ষা খাতে ৩০ শতাংশ এবং জলবায়ু-ঝুঁকি তহবিল খাতে ১০ শতাংশ ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব বিবেচনায় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে নির্ধারিত ৬০ শতাংশ ব্যয়ের পরিমাণ ও যথার্থতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ফরম্যাটে এ সংক্রান্ত ব্যয়ের তথ্য পাঠানোর কথা সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে।

bank

সিরাজুল ইসলাম

বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিএবির সেক্রেটারি জেনারেল স্বাক্ষরিত চিঠিতে ১৩ দফা সুপারিশে ব্যাংকগুলোতে চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপ-শাখা খোলা বন্ধ রাখতেও ব‌লা হ‌য়।

সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘করোনাভাইরাসে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মী ছাঁটাই না করে ব্যাংককে সচল রাখার জন্য প্রস্তাবগুলো দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য এসব পদক্ষেপ ব্যাংকগুলো গ্রহণ করতে পারে।’

চিঠিতে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ‘নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা এবং সাব ব্রাঞ্চ খোলা বন্ধ রাখা; সম্পদ (ফিক্সড) ক্রয় বন্ধ রাখা; স্থানীয় ও বিদেশে ট্রেনিং বন্ধ রাখা; সব বিদেশ ট্যুর বন্ধ রাখা; সিএসআর, ডোনেশন ও চ্যারিটি বন্ধ রাখা; পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখা; সব কাস্টমার গেট-টুগেদার বন্ধ রাখা; কর্মকর্তাদের গেট টুগেদার বা ম্যানেজারদের কনফারেন্স বন্ধ করা। দরকার হলে ভার্চুয়ালি করা; আইটি সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ক্রয় সীমিত রাখা; অন্য সব খরচ সীমিত রাখা।’

বিএবির এমন সুপারিশের খবর ছড়িয়ে পড়লে ব্যাংকগুলোর কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। পরবর্তীতে বেতন-ভাতা কমানোর সুপারিশ থেকে সরে আসে বিএবি। নতুন করে তারা বলে, ‘ব্যাংকগুলো কোন প্রক্রিয়ায় ব্যয় কমাবে তার সিদ্ধান্ত স্ব স্ব ব্যাংকের পর্ষদ নেবে।’ কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুপারিশগু‌লো ঠিকই বাস্তবায়ন কর‌ছে অনেক ব্যাংক— এমন অভিযোগও রয়েছে।

bank

জানা গে‌ছে, করোনা মহামারিকালে ব্যয় কমা‌নোর না‌মে ইতোম‌ধ্যে তিনটি ব্যাংক তা‌দের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ক‌মি‌য়ে‌ছে। বিএবির পরামর্শে কর্মকর্তাদের বেতন কমাতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। তাদের মধ্যে অন্যতম বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ বেতন কমিয়েছে। এটি ১ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে, বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাশাপাশি সিটি ব্যাংক ও এবি ব্যাংকে ইতোমধ্যে কর্মকর্তাদের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক বেতন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে।

সিটি ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৬ শতাংশ বেতন-ভাতা কমিয়েছে। বেতন কমানোর এই সিদ্ধান্ত চলতি মাসের ১ জুন থেকেই কার্যকর হচ্ছে। এটি বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবি ব্যাংক মে ও জুন মাসের বেতন ৫ শতাংশ কমিয়েছে। আগামী মাসগুলোতে বেতন কমবে কি-না, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

তবে কর্মীদের বেতন-ভাতা না কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বেসরকারি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেড। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ চিঠি জারি করেছে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটি। এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, করোনা সংকটকালীন এ সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকাররা গ্রাহক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময়ে বেতন কমানো অনৈতিক। তাই সাউথ বাংলা ব্যাংক তাদের পর্ষদ সভায় এই আপদকালীন সময়ে ব্যাংকারদের বেতন না কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এসআই/এমএআর/জেআইএম

খরচ কমাতে হলে বেতন কমাতে হবে কেন? সিএসআর বন্ধ করতে হবে কেন? এটি না করেও ব্যয় কমানোর আরও অনেক খাত রয়েছে

সিএসআর কার্যক্রমের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। ব্যাংকগুলোকে এ নীতিমালা পরিপালন করতে হবে। এটি পালন না করা আইনের পরিপন্থী

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।