প্রণোদনার সহায়তা পাননি এসএমই উদ্যোক্তারা, প্রক্রিয়া সহজের দাবি
করোনা (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ হতে এসএমই উদ্যোক্তারা এখনও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা পাননি। ঋণ প্রদানে বিদ্যমান প্রক্রিয়াও অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত সহজীকরণ করা প্রয়োজন।
বুধবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তরণ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী আলোচকরা এমন অভিমত দেন। প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ সহায়তার আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং পিকেএসএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ সহায়তা প্রদানের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তিকরণেরও দাবি জানান আলোচকরা।
ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এ ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফারাহ মো. নাসের। এতে বিভিন্ন ব্যাংকের এসএমই শাখার প্রধানরা বিদ্যমান ঋণ পরিস্থিতির ওপর মতবিনিময় করেন।
ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে কটেজ, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩ মিলিয়ন, যারা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৩৫.৪৯ শতাংশের জোগান দিচ্ছে।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অন্যান্য খাতের মতো ‘কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাবৃন্দ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এ অবস্থা উত্তরণে সরকারের পক্ষ হতে ইতোমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ সহায়তা ও প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা চেম্বার ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের সাথে মতবিনিময় করেছে এবং উদ্যোক্তারা বেশিরভাগই প্রণোদনা প্যাকেজ হতে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা না পাওয়ার বিষয়টিকে বর্তমান পরিস্থিতি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ডিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ এবং এ খাতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৩৫.৫ শতাংশ লোক জড়িত, যারা মোট রফতানিতে প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ অবদান রাখছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিক্রি প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে এবং উদ্যোক্তাদের প্রায় ৬২.৪ শতাংশ কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ ট্যাক্স, ভ্যাট প্রদানে সক্ষমতা হারিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুতকরণে উদ্যোক্তারা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং ডিসিসিআই পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ৫৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা মনে করেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণ সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়া বেশ জটিলতর। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঋণ প্রদানের পদ্ধতি সহজতর করা এবং প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে ঋণ প্রদানের গতি আরও বেগবান করা প্রয়োজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফারাহ মো. নাসের বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্যই মূলত প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে এবং প্যাকেজের আওতায় উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা প্রদানে ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। বর্তমান পরিস্থিতি ঋণ প্রদান ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক এবং গ্রাহকদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময় বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের ঋণ নেয়া এবং তাদের ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতা খতিয়ে দেখার জন্য ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ওপর আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ সহায়তাটি ‘ওয়ার্কিং লোন’-এর ন্যায় ‘টার্ম লোন’ হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বাস দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্বাহী পরিচালক।
নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কপোরেশনের (বিসিক) মহাব্যবস্থাপক আখিল রঞ্জন তরফদার, এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজিম হাসান সাত্তার এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব ফেরদৌসি বেগম অংশগ্রহণ করেন।
বিসিকের মহাব্যবস্থাপক আখিল রঞ্জন তরফদার বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ২৮ শতাংশ ব্যাংক হতে ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকে এবং এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা প্রদানের হার বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আসতে হবে।
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য বিসিকের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সারাদেশে ৭৬টি বিসিক শিল্পনগরী রয়েছে, যেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে সার্ভিস চার্জ মওকুফ করেছে। এছাড়া ভবিষ্যতে সারাদেশে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আরও ৫০টি শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজিম হাসান সাত্তার বলেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার প্যাকেজ হতে উদ্যোক্তারা কীভাবে ঋণ সহায়তা পাবে, সে ব্যাপারে গাইডলাইন প্রস্তুুত করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। প্রণোদনার প্যাকেজ হতে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংঘবদ্ধভাবে আবেদনের প্রস্তাব করেন এবং এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
এমএএস/এমএসএইচ/পিআর