মন্দা কাটছেই না বেভারেজ আর আইসক্রিমের ব্যবসায়
বছরের মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেভারেজ আর আইক্রিমের ভরা ব্যবসা হয়। কিন্তু পরপর দুই বছরই এই সময় করোনা প্রকট আকার ধারণ করায় ব্যবসা হচ্ছে না এসব পণ্যের। টানা বিক্রি কমায় এখন লোকসান গুনছেন এসব পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো।
কয়েকটি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার প্রকোপ শুরুর প্রথম দিকেই এক ধরনের বিপত্তির মুখে পরে এ শিল্পগুলো। ঠান্ডা খাবার করোনার সংক্রমণ বাড়ায় এমন প্রচারের কারণে বেভারেজ এবং আইসক্রিমের বিক্রি একদম কমে যায়। কিছু মাসের মধ্যে সে বিষয়টি ভুল জানা গেলেও এরপর শুরু হয় লকডাউনের ‘খড়্গ’।
তারা বলছেন, লকডাউনে নিত্যপণ্যের দোকানপাট দুপুর পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু এসব পণ্যের পিক আওয়ার (বিক্রির সেরা সময়) বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। ওই সময়ই দোকানপাট বন্ধ থাকায় বিক্রি দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।
এছাড়া দুই ঈদে এবং পহেলা বৈশাখ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এসব পণ্যের বিক্রি ভালো হয়। গত দুই বছরের চারটি ঈদ ও দুই বৈশাখে বিধিনিষেধের কারণে তাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য বিক্রি হয়নি। এছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। এছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে বেড়েছে পণ্য আনা-নেয়ার খরচ এবং কাঁচামালের দাম।
দেশের অন্যতম বেভারেজ পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেভারেজের প্রায় ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় সন্ধ্যার পরে। সে সময় দোকানপাট বন্ধ। পাশাপাশি দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ খাতে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
অরেকটি বড় সমস্যার কথা জানিয়ে মাইদুল ইসলাম বলেন, বেভারেজ পণ্যের মেয়াদ খুব কম। যেহেতু বিক্রি নেই, তাই মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে প্রচুর লোকসান হচ্ছে। গত বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে ড্যামেজ দিতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, গত ঈদে অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিক্রির টার্গেট বেশি ছিল। কিন্তু ৭০ শতাংশ হয়েছে। বিক্রির ধরন পাল্টে গেছে, শহরে কঠোরতা বেশি হওয়ার কারণে বিক্রি কম। এখন গ্রামেই বিক্রি বেশি। সেটাও চিন্তার কারণ, যেহেতু গ্রামে আবার মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে ড্যামেজ বেশি।
এখন বেভারেজের সার্বিক বাজার যেমন
বেভারেজ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রায় ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বেভারেজের বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর যা ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে করোনার আগে। এখন এ বাজার অর্ধেকে নেমেছে।
বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিএমএ) তথ্য বলছে, তাদের সদস্যদের উৎপাদিত পণ্যসমূহ বর্তমানে ৯০টির বেশি দেশে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া পাশ্র্ববর্তী দেশগুলোতে বাংলাদেশের বেভারেজের বড় বাজার তৈরি হয়েছে, যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
দেশে বেভারেজের উৎপাদনখাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানি এ খাতে বড় বিনিয়োগ করেছে।
কয়েক বছর আগের এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশের শহরের নাগরিকরা প্রতি বছর ১২ লিটার কোমলপানীয় পান করে। শহর-গ্রাম দুটো মিলিয়ে গড়ে একজন মানুষ বছরে মাত্র ৩ দশমিক ৬ লিটার কোমলপানীয় পান করে, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় কম।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের কোমলপানীয় পানের পরিমাণ অর্ধেকে নেমেছে বলে মনে করে বিবিএমএ।
আইসক্রিমের বিক্রি কমেছে ৬০ শতাংশ
একটি কোম্পানির শেষ এক পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে দেশে আইসক্রিমের বাজার ছিল ১৪শ কোটি টাকার। সেটা শুধু করপোরেট কোম্পানিগুলোর। যেখানে ৮টি বড় কোম্পানি এক থেকে একাধিক ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বিক্রি করছে। যাদের নিজস্ব বড় পরিসরে কারখানা রয়েছে।
পাশাপাশি সারাদেশে ছোট ও মাঝারি শত শত ব্র্যান্ড রয়েছে। সব মিলিয়ে এ বাজার দুই হাজার কোটি টাকার বেশি।
খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে আইসক্রিমের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও আয় দ্রুত বাড়ছে। এ খাতে কয়েক লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
আইসক্রিমের বাজারে সবচেয়ে বড় শেয়ার ইগলু আইসক্রিমের। ইগলুর সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুমিত চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি কোম্পানির বিক্রি ৬০ শতাংশ কমেছিল গত বছর (২০২০)। এ বছর প্রথম দিকে কিছুটা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গত জুন থেকে আবারও বাজার ফল করেছে।
তিনি বলেন, ইগলুও গত দুই মাস থেকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যার মূল কারণ লকডাউন এবং মানুষের হাতে টাকা না থাকা। সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ থাকায় বিক্রি একদম কম হচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা নেই বলে এ ধরনের খাবারের বিক্রি কমেছে।
জানা গেছে, দেশের বেশকিছু আইসক্রিম কোম্পানি ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্দও রয়েছে কয়েকটি কোম্পানির।
এনএইচ/এসএইচএস/জিকেএস