দুই দশকে ডিমের হালি ১২ থেকে ৫৫ টাকা

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:৪৫ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০২৩
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

দেশে পোল্ট্রি শিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে ২০০০ সালের পর। দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোও এসময় তাদের উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত করা শুরু করে। প্রতিটি ডিমের দাম ওই সময় ছিল তিন টাকার কম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যও বলছে, ২০০৬ সাল পর্যন্ত এক হালি ডিমের দাম ছিল ১২ টাকার মধ্যে। দুই দশকের ব্যবধানে এখন এক হালি ডিম কিনতেই গুনতে হচ্ছে ৫৫ টাকা।

২০০৬ সালে অতীতের সব হিসাব ওলট-পালট করে দেয় বার্ডফ্লু সংক্রমণ। ধাক্কা আসে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে। প্রতিদিন বন্ধ হতে থাকে নতুন নতুন খামার। কয়েক বছরে প্রচুর খামার বন্ধ হয়ে তৈরি হয় সরবরাহ সংকট। ডিমের দামও দফায় দফায় বেড়ে ২০০৯-১০ সালের দিকে দ্বিগুণেরও বেশি হয়।

আরও পড়ুন>> হাত বদলেই ডজনে ডিমের দাম বাড়ছে ২০ টাকা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে এসে দেশে প্রতি হালি মুরগির ডিমের গড় দাম দাঁড়ায় ২৬ টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ, ওই সময় তিন থেকে চার বছরের ব্যবধানে ডিমের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরে ডিমের গড় দাম কিছুটা কমে, যা প্রতি হালি ২৫ টাকারও কম ছিল। তবে সে সুদিন বেশিদিন থাকেনি। পরের বছর ২০১১-১২ সালে এসে সাড়ে ২৯ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

তখনকার বড় উল্লম্ফন হয় ২০১২ সালে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে সে সময় বাংলাদেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ছিল কমবেশি ৭০ হাজার। আর ওইসব খামার থেকে প্রতিদিন এক কোটি ৬০ লাখ ডিম এবং দেড় লাখ মুরগি পাওয়া যেত। ঠিক তখনই ফের হানা দেয় বার্ডফ্লু। মাত্র তিন মাসের সংক্রমণে ৪০ হাজার খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য দেয় পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সমন্বয় কমিটি।

দুই দশকে ডিমের হালি ১২ থেকে ৫৫ টাকা
বাজারে ডিম/ফাইল ফটো

বিবিএস বলছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ডিমের হালিপ্রতি গড় দাম এসে দাঁড়ায় ৩৭ টাকা ১৩ পয়সায়। এক বছরে এ ব্যবধান সর্বোচ্চ, যা আগের বছরের চেয়ে হালিপ্রতি ৮ টাকা বেশি। অর্থাৎ, প্রতিটি ডিমের দাম দুই টাকা বেড়ে তখন দাঁড়ায় সাড়ে ৯ টাকার কাছাকাছি।

আরও পড়ুন>> ডিমও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে, ডজন ১৫০ টাকা

পরের বছর (২০১৩-১৪ অর্থবছর) দাম কিছুটা কমেছিল। গড় দাম আবারও প্রতি হালি ৩২ টাকায় নামে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ডিমের গড় দাম সাড়ে ৩৩ টাকার মধ্যে ছিল। পরবর্তী টানা তিন বছর হালিপ্রতি ডিমের দাম গড়ে প্রায় এক টাকা করে বেড়ে ৩৬ টাকা পর্যন্ত ওঠে। অর্থাৎ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিমের দাম ছিল ৩৬ টাকা ২৫ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তুলনামূলক বেশি বাড়ে দাম। তখন প্রতি হালি ডিমের দাম বাড়ে ৩ টাকা। ওই বছর গড় দাম ছিল ৩৯ টাকা ৪২ পয়সা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিমের দাম ওই পর্যন্ত (২০২১-২২ অর্থবছর) বৃদ্ধির মধ্যে স্বাভাবিকতা রয়েছে। তবে গত বছর থেকে বৃদ্ধি অযৌক্তিক। সবশেষ গত জুলাইয়ে যেখানে গড় দাম ছিল ৪০ টাকার কিছু কম, সেটা এখন কমপক্ষে ৫২ টাকায় ঠেকেছে।

ঢাকার পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান থেকে ফার্মের মুরগির এক হালি ডিম কিনতে লাগছে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে গেলে ৫০-৫২ টাকা। ফলে মুদি দোকানের দাম ধরলে এখন একটি ডিমের দাম পড়ে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা। সে হিসাবে গড় করলে গত এক বছরে প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ টাকার কাছাকাছি, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।

দুই দশকে ডিমের হালি ১২ থেকে ৫৫ টাকা
বাজারে ডিম/ফাইল ফটো

দেশে হঠাৎ কেন ডিমের দাম এত অস্বাভাবিক বাড়ছে তার কোনো সদুত্তোর নেই কারও কাছে। সরকার বলছে সিন্ডিকেট, তাই ডিমের দাম সরকার সর্বোচ্চ ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদিও প্রায় একমাসে সে দাম বাস্তবায়ন হয়নি। সেজন্য আবার বিদেশ থেকে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়ে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা চলানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এ পরিমাণ ডিম দিয়ে দেশের তিন থেকে চারদিনের চাহিদা পূরণ সম্ভব। কারণ এখন প্রতিদিন চার কোটি ডিমের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট বড় বড় প্রতিষ্ঠান মুখে কুলুপ এঁটেছেন সিন্ডিকেট নিয়ে। তাদের তেমন কোনো বক্তব্য নেই। অন্য বছরগুলোতে প্রতিদিন নানা বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া গেলেও এখন পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সমন্বয় কমিটিসহ অন্য অ্যাসোসিয়েশনগুলো যেন নিশ্চুপ।

দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে আসছে ছোট ছোট খামারি ও ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘করপোরেটদের সিন্ডিকেটের কারণে ডিমের দামে এ অবস্থা হয়েছে। করপোরেট গোষ্ঠীগুলো এখন ডিমে ৬০ শতাংশ মুনাফা করছে। এছাড়া তারা মুরগির বাচ্চায় ১০০-২০০ শতাংশ, ফিডে ৫০ শতাংশ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ডিমের দামে।’

আরও পড়ুন>> ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ, আমদানির সিদ্ধান্ত

সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ডিম আগের দামে ফিরিয়ে নিতে হলে খাবার (ফিড) ও মুরগির বাচ্চার দাম স্বাভাবিক করতে হবে। করপোরেটরা এখন ছোট ছোট খামারিদের ধ্বংস করে বাজার মনোপলি করেছে। কোভিডের আগে কোম্পানিগুলো ডিম সেভাবে উৎপাদন করেনি। তারা কেবল ফিড ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করতো। কিন্তু কোভিডের পরে তারা ১৫ শতাংশ ডিমের ব্যবসায় নেমেছে এবং এরপর থেকেই বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।’

দুই দশকে ডিমের হালি ১২ থেকে ৫৫ টাকা
ডিমের মুরগির খামার/সংগৃহীত

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি ও কাজী ফার্মস লিমিটেডের পরিচালক কাজী জাহিন হাসানের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি গণমাধ্যমে সিন্ডিকেটের অভিযোগ নিয়ে তিনি একটি বিবৃতি দেন। তাতে বলেন, ডিমের দাম অস্থির করার বিষয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্যায়ভাবে দায়ী করা হয়। দেশে দৈনিক ডিমের গড় চাহিদা প্রায় চার কোটি পিস, যার মাত্র ১৫ শতাংশ উৎপাদন করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে যে কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। ডিমের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দামের কারণে সহজলভ্য এই প্রাণিজ আমিষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। শুধু ডিম নয়, একই সময়ে অন্য নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষও বিপাকে রয়েছে। সরকার চাইলেও যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এটা ডিমসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার পরে দেখা গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।