অস্থির খেজুরের বাজার

বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম, ‘মজুতে’ কৃত্রিম সংকট

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৮:২১ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

• অতিরিক্ত শুল্ক, ডলার সংকট, এলসি জটিলতায় দাম বাড়ছে
• বাজারে না ছেড়ে কোল্ড স্টোরেজে মজুতের অভিযোগ
• শুল্ক কমানো হলেও দামে প্রভাব পড়ছে না
• লোকসানের শঙ্কায় এবার খেজুর আমদানি কম

পবিত্র রমজান সামনে রেখে অন্য ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি অস্থির হয়ে উঠেছে খেজুরের বাজার। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও হু হু করে বাড়ছে এ পণ্যটির দাম। এক বছরের ব্যবধানে ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়েছে রমজানের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দাম। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে খেজুরের চাহিদার পাশাপাশি জোগানও (আমদানি) কমেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক, ডলার সংকট, এলসি জটিলতার কারণেই খেজুরের দাম বাড়ছে।

অন্যদিকে আড়তদার ও কমিশন এজেন্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আমদানিকারকরাই খেজুরের বাজার অস্থির করে রেখেছেন। বন্দর থেকে নতুন খালাস নেওয়া খেজুর বাজারে না এনে কোল্ড স্টোরেজে মজুত করে রাখা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে খেজুরের সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা বাজার নগরীর বিআরটিসি ফলমন্ডিতে। পাশাপাশি খাতুনগঞ্জেও রয়েছে খেজুরের ব্যবসা। ফলমন্ডির ব্যবসায়ী মো. রফিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগেকার দিনে শুধু রমজান এলেই মানুষ খেজুর খেতেন। এখন সেটি নেই। সারাবছরই খেজুরের কমবেশি চাহিদা থাকে। তবে রমজানে খেজুরের চাহিদা বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও। খেজুরও বাদ যায়নি। গত বছরের চেয়ে এবার খেজুরের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।’

আরও পড়ুন
শুল্ক কমালেও দফায় দফায় বাড়ছে খেজুরের দাম
রোজার আগেই খেজুরের দামে অস্থিরতা

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা গেছে, রমজান সামনে রেখে জমজমাট বেচাকেনা চলছে ফলমন্ডির খেজুর মার্কেটে। বিভিন্ন জেলার আড়তদার ব্যবসায়ীরাও খেজুর সংগ্রহে ভিড় করেছেন। চট্টগ্রামে খেজুরের পাইকারি এ বাজারে জাহেদি, সাইয়িদি, ফরিদি, সাফায়ি, রশিদি, মাশরুখ, মাবরুর, নাগাল, কুদরি, আজওয়া, মেদজুল, মরিয়ম, দাব্বাস, সুক্কারিসহ নানান জাতের ও নামের খেজুর রয়েছে। একই খেজুর ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডেও রঙিন প্যাকেটে বাজারজাত হয়ে আসছে।

ফলমন্ডির ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৌদি, ইরান, মিশর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, দুবাই থেকে বেশিরভাগ খেজুর আসে। সৌদি, ইরান, মিশরের খেজুর মানসম্মত হয়। এসব খেজুরের দামও বেশি। বাজারে মধ্যম মানের খেজুর আসে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে।

অস্থির খেজুরের বাজার, বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম, ‘মজুতে’ কৃত্রিম সংকট
বাজারে না ছেড়ে কোল্ড স্টোরেজে খেজুর মজুতের অভিযোগ

রোববার চট্টগ্রাম ফলমন্ডিতে ইজেড নাগাল ব্র্যান্ডের খেজুর পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ২৫০ টাকায়, আলজেরিয়ান ডেটলাইন নাগাল ১০ কেজির প্যাকেট তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ২৫০ টাকা, তিউনিসিয়ান টেটকো ফরিদি পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ২৫০ টাকা। সৌদিয়ান মাশরুখ বিনা ব্র্যান্ডের পাঁচ কেজির খেজুর বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৬০০ টাকা। মাশরুখ-বি ব্র্যান্ডের পাঁচ কেজির খেজুর বিক্রি হয়েছে আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার ৫৫০ টাকায়। মাশরুখ ভিআইপি বিক্রি হয়েছে পাঁচ কেজি দুই হাজার ৬৫০ টাকায়।

এছাড়া ক্রাফট ব্র্যান্ডের ইরানি মরিয়ম খেজুর পাঁচ কেজি বিক্রি হয়েছে চার হাজার ১০০ টাকা, সৌদিয়ান গ্যালাক্সি ব্র্যান্ডের মাবরুর খেজুর পাঁচ কেজি সাত হাজার ৭০০ টাকা, তিন কেজির সৌদিয়ান আজওয়া খেজুরের প্যাকেট
চার হাজার ৩০০ টাকা, মিশরের মেদজুল খেজুর পাঁচ কেজি ছয় ৬০০ টাকা, সৌদিয়ান দারআলহিজরি ব্র্যান্ডের কুদরি খেজুর পাঁচ কেজি এক হাজার ৭৮০ টাকা, মদিনা ব্র্যান্ডের রশিদি পাঁচ কেজি এক হাজার ৩০০ এবং সৌদিয়ান রামা ব্র্যান্ডের জাহিদি খেজুর ১০ কেজি বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়। এক বছর আগেও এসব খেজুরের দাম অর্ধেকের নিচে ছিল বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বাজারে জাহেদি ও ফরিদি খেজুর বেশি চলে বলে জানান তারা।

আরও পড়ুন
আমদানি কম: রমজান না আসতেই খেজুরের দামেও উত্তাপ
রমজানে ৮ পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে আমদানি সহজ করার নির্দেশ

অন্যদিকে সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) খাতুনগঞ্জের বাজারে জাহেদি ব্র্যান্ডের খেজুর ১০ কেজির প্যাকেট দুই হাজার ৫৫০ এবং একই পরিমাণ সাইয়িদি খেজুর বিক্রি হয় তিন হাজার ৭০০ টাকায়। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই সপ্তাহ আগেও এসব খেজুরের দাম প্যাকেটপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কম ছিল।

খাতুনগঞ্জে খেজুরের বড় ব্যবসায়ী ও চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে খেজুর নিয়ে বাজারে পাইকারি বিক্রি করি। দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। দাম বাড়াচ্ছেন আমদানিকারকরা। তারা একই খেজুর আজ এক দামে তো কাল আরেক দামে বিক্রি করছেন। তারা বন্দর থেকে খেজুর খালাস নিয়ে বাজারে আনছেন না। এখনো বাজারে পুরোনো খেজুর বিক্রি হচ্ছে। নতুন খালাস নেওয়া খেজুর আমদানিকারকরা বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে মজুত করছেন। এতে মূল পাইকারি বাজারে সংকট তৈরি করা হচ্ছে। ফলে খেজুরের দাম বাড়ছে।’

এদিকে রমজান মাসক সামনে রেখে চাল, তেল, চিনির পাশাপাশি খেজুরের দামও সহনীয় রাখতে শুল্ক কমানোর আদেশ জারি করেছে সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঘোষিত পরিপত্রে খেজুর আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়। ৮ ফেব্রুয়ারির আগে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কে (সিডি) খেজুর শুল্কায়ন হতো। বর্তমানে সেখানে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), পাঁচ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) এবং তিন শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আগের মতোই রয়েছে।

আরও পড়ুন
রমজানে নিত্যপণ্যের মজুতদারি-চাঁদাবাজি ঠেকাবে পুলিশ-র‌্যাব
ভারতীয় পেঁয়াজ রোজার আগেই বাজারে ঢুকবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

খেজুরের শুল্ক কমানো হলেও দামে প্রভাব পড়ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, হিমায়িত কনটেইনারে আমদানি হওয়া খেজুর চার ডলারের অ্যাসেসমেন্ট (শুল্কায়ন) মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে কার্টনজাত সব খেজুরের শুল্কায়ন মূল্য আড়াই ডলার, খুচরা প্যাকেটজাত খেজুরে দুই ডলার ৭৫ সেন্ট, বস্তায় আমদানি হওয়া শুকনা খেজুর আড়াই ডলার এবং বস্তায় আমদানি হওয়া ভেজা খেজুর এক ডলার হিসেবে শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করেছে কাস্টম।

অস্থির খেজুরের বাজার, বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ দাম, ‘মজুতে’ কৃত্রিম সংকট
শুল্ক কমানো হলেও দামে প্রভাব পড়ছে না

চট্টগ্রাম ফলমন্ডির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী মেসার্স আলী জেনারেল স্টোর। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার বোরহান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘খেজুরের মান ভালো রাখার জন্য অনেক সময় রেফার্ড (রেফ্রিজারেটর সুবিধাসম্পন্ন) কনটেইনারে আমদানি করা হয়। অথচ ড্রাই (সাধারণ কনটেইনার) কনটেইনার এবং রেফার্ড কনটেইনারে ফ্রেইট (জাহাজভাড়া) তেমন বেশি নয়। সাধারণ কনটেইনারে আনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই ডলার ৭৫ সেন্টে অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। অথচ রেফার্ড কনটেইনারের ক্ষেত্রে চার ডলার হিসেবে অ্যাসেসমেন্ট করা হচ্ছে। একদিকে শুল্কহার ১০ শতাংশ কমানো হলেও শুল্কায়ন মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে শুধু আমদানি শুল্ক কমানো হলেও খেজুরের দামে কোনো প্রভাব পড়ছে না।’

তিনি বলেন, ‘রমজানে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে এবার চাহিদা অনেক কম। গত বছর যে ডলার ১০৫ টাকায় এলসি করা হয়েছিল, এবার সেই ডলার ১২৫-১২৬ টাকায় কিনে এলসি করতে হয়েছে। শুধু এক ডলারেই ২০ টাকা বেশি খরচ করতে হয়েছে। অন্যদিকে এলসি করার ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। সবগুলো মিলিয়ে বাজারে খেজুরের দাম অত্যধিক বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়েছে দাম।

আরও পড়ুন
রোজার আগে রসুন ও খেসারি ডালের দাম বেড়েছে
অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তৌহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে আগে কম দামে যে খেজুর (ভেজা খেজুর) বিক্রি হতো, সেগুলোতে কেজিপ্রতি ১০ টাকা কাস্টম ট্যাক্স দিতে হতো। এখন সেই খেজুরের প্রতি কেজিতে ৬৭-৬৮ টাকা ডিউটি দিতে হয়। সরকার শুল্ক কমানোর কথা বলে কমিয়েছে কেজিতে ১০-১২ টাকা। কিন্তু বাড়িয়েছে ৫০-৬০ টাকা।’

তিনি বলেন, ‘এলসি করে খেজুর আমদানি করে দেশে খালাস নিতে ৪৫ দিনের বেশি সময় ব্যয় হয়। যখন শুল্ক কমানো হয়েছে, তখন নতুন করে এলসি দিয়ে রমজানের আগে খেজুর আমদানির সুযোগ নেই। তাই শুল্ক কমানোর সুবিধা নিয়ে বেশি খেজুর আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আগে যেগুলো এলসি করা হয়েছে, সেই খেজুরই খালাস হয়ে ক্রমান্বয়ে বাজারে আসছে।’

আগে যেগুলো ৩০ সেন্টে শুল্কায়ন হতো, সেটা এবার এক ডলার করা হয়েছে। যেগুলো ৬০-৭০ সেন্টে শুল্কায়ন হতো, এগুলো করা হয়েছে দুই ডলারের বেশি। সর্বোচ্চ ৪ ডলারেও শুল্কায়ন করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা লোকসানের শংকায় এবার খেজুর আমদানি কম করেছেন। যার প্রভাব রয়েছে বাজারেও।

ইএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।