কম দামে বেচা তেল বেশি দামে কিনলো বিপিসি, গচ্চা ১২৫ কোটি

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ০৫ মার্চ ২০২৪

•নিজেদের কমিটির সুপারিশ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সভায় মুখ খুললেন না চেয়ারম্যান
•৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল কেনাতেই ১২৫ কোটি টাকার বেশি গচ্চা

দেশে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ৩৩৫ মেগাওয়াট সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (এসএমপিসিএল) কাছে কম দামে বিক্রি করা একই ডিজেল পুনরায় চার বছর পর লিটারে ৪০ টাকা বেশিতে কিনেছে বিপিসি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ট্যাংকে পড়ে থাকা এসব অফ-স্পেক ডিজেল ব্লেন্ডিং ছাড়া বাজারে ছেড়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে আসে এসব অনিয়ম। নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের করা দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।

কম দামে বেচা ডিজেল চার বছর পর লিটারপ্রতি ৪০ টাকা বেশি দিয়ে কিনেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ৩৩৫ মেগাওয়াট সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড থেকে ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল কিনতে গিয়ে পরিশোধযোগ্য সরকারি রাজস্ব বাদেও ১২৫ কোটি টাকার বেশি গচ্চা দিতে হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটিকে।

জাগো নিউজের হাতে আসা বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদের সই করা প্রতিবেদন এবং ১৮ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনায় পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মাধ্যমে ৩৩৫ মেগাওয়াট সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (এসএমপিসিএল) থেকে এসব তেল কেনে বিপিসি। সম্প্রতি এসব ডিজেলের মূল্য পরিশোধ করা নিয়ে নানান টানাপোড়েনে আলোচনায় আসে বিষয়টি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে বিক্রি করা এসব ডিজেল ২০২৩ সালের ২৫ জুন থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এবং যমুনা অয়েল কোম্পানির গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপো গ্রহণ করে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিপিসির জ্বালানি (ডিজেল) সরবরাহের চুক্তি রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল থেকে ডিজেল নেয় এসএমপিসিএল। এ প্ল্যান্টে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলে ডিজেলের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ দুই বছর (২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আগে) বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৩ কোটি ১০ লাখ লিটার ডিজেল অব্যবহৃত রয়ে যাওয়ার কথা পিডিবিকে জানায় এসএমপিসিএল। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর এসব ডিজেল ক্রয় করার অনুরোধ জানিয়ে বিপিসিকে চিঠি দেয় পিডিবি।

আরও পড়ুন>> ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটে যুক্ত হচ্ছে এস আলম 

এরপর ক্রয়ের লক্ষ্যে মজুত করা ডিজেলের পরিমাণ নিরূপণ, গুণগত মান যাচাইকরণ, ডিজেলের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণসহ ওই ডিজেল গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। কমিটি ওই বছরের ৩০ মার্চ বিপিসি চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদন দেয়।

প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, ‘সামিটের প্ল্যান্টে মজুত থাকা ডিজেলে সালফারের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ওই ডিজেল অফ-স্পেক বিবেচনায় বিশ্ববাজার থেকে ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিপিসি’র আমদানি ব্যয়ের তুলনায় ৫ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে ওই ডিজেল ক্রয় করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে সময়ে বিপিসি কর্তৃক ডিজেল গ্রহণ করা হবে।

এরপর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যুক্ত করে ২০২৩ সালের ১০ মে পিডিবিকে চিঠি দেয় বিপিসি। বিপিসির প্রতিবেদনটি পরবর্তী ২৩ মে তারিখে পিডিবির ১৯৯৫তম সভায় উপস্থাপন করা হয়। যথারীতি বিপিসির ওই সুপারিশটি পিডিবির বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়। এরপর পিডিবি, তেল বিপণন কোম্পানি, সার্ভেয়ার ও সামিটের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ‘মূল্য কমিটি’ ও সাব-কমিটির উপস্থিতিতে ২০২৩ সালের ২৫ জুন থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ১৬টি কনসাইমেন্টে ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল গ্রহণ করে পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা অয়েল।

আরও পড়ুন>> ‘বিপজ্জনক’ জ্বালানি প্ল্যান্ট অনুমোদন নিয়ে বিপিসিতে তোলপাড় 

এসব ডিজেল বিপিসি গ্রহণের পরপরই ২০ আগস্ট বিপিসিকে আরেকটি চিঠি দেয় পিডিবি। মূলত ওই চিঠিতে জ্বালানি বিভাগের সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৯ আগস্টের গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ডিপো মূল্য লিটারপ্রতি ১০৫ টাকা ৪৩ পয়সা থেকে ৫ শতাংশ হ্রাস করে এবং জাহাজের ভাড়া কর্তন করে ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় হিসাব করে গ্রহণকৃত ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেলের বিপরীতে ৩০৮ কোটি ৫৮ লাখ ২৩ হাজার ২১৬ টাকা ৯০ পয়সা পিডিবি-সামিটের গঠিত এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় বিপিসিকে। এতে বিপিসির সুপারিশ করা দরের চেয়ে পিডিবি বেশি দাবি করায় বিপত্তি তৈরি হয়।

বিপিসি চেয়ারম্যানের দ্বিমুখী আচরণ

বিপিসির সুপারিশের চেয়ে পিডিবি বেশি দাম চাইলে গ্রহণকৃত ডিজেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে নির্দেশনা চেয়ে ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জ্বালানি সচিবকে চিঠি দেন বিপিসি চেয়ারম্যান। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিপিসি কমিটির সুপারিশ মতে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হিসাব করে ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেলের গড় প্ল্যাটস মূল্য, গড় প্রিমিয়াম, ডলারের গড় বিনিময়হার, ভ্যাট ও অফ-স্পেক বিবেচনায় ৫ শতাংশ হ্রাস করে পরিশোধযোগ্য ডিজেলের মূল্য হবে ১৭০ কোটি ৪৬ লাখ ২৭ হাজার ৬২০ টাকা ১৫ পয়সা। এখানে পিডিবির প্রস্তাবিত মূল্য বিপিসির কমিটির সুপারিশ করা মূল্যের চেয়ে ১৩৮ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৫৯৬ টাকা ৯৫ পয়সা পার্থক্য (বেশি)।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবকে দেওয়া বিপিসি চেয়ারম্যানের সেই চিঠির এক অংশে উল্লেখ করা হয়, বিপিসির কমিটি কর্তৃক সামিটের প্ল্যান্ট থেকে সংগৃহীত ডিজেলের জন্য সুপারিশ করা মূল্য কাঠামো (যা সব ক্ষেত্রে বিধিগতভাবে বিপিসি প্রয়োগ করে) পিডিবির ১৯৯৫তম বোর্ড সভায় হুবহু অনুমোদন করা সত্ত্বেও ২০ আগস্টের চিঠিতে পিডিবি যে প্রক্রিয়ায় বা মূল্য কাঠামোর ভিত্তিতে সংগৃহীত ডিজেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে, তার ফলে বিপিসির পক্ষে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগে ওই চিঠি দেওয়ার পর এসব ডিজেলের মূল্য পরিশোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপির সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। জ্বালানি বিভাগের সচিবকে লেখা আগের চিঠিতে বিপিসি চেয়ারম্যান ‘পিডিবির প্রস্তাবিত মূল্য বিপিসির কমিটির সুপারিশ করা মূল্যের চেয়ে ১৩৮ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৫৯৬ টাকা ৯৫ পয়সা পার্থক্য’ থাকার কথা উল্লেখ করলেও মন্ত্রণালয়ের সভায় এ নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। বরং সামিট ও পিডিবির পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন>> বিপিসির জ্বালানি সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা 

মন্ত্রণালয়ের ওই সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, বিপিসির চেয়ারম্যান সভাকে জানান, বিপিসি দেশের চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে সরবরাহ করে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিজেলের ক্রয়মূল্য একটি ফর্মুলার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বিক্রয় করা পণ্য পুনরায় গ্রহণ ও তার মূল্য নির্ধারণে কোনো ফর্মুলা নেই। সেজন্য এ (সামিটের) ডিজেলের মূল্য আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এছাড়া এরই মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য একাধিকবার সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে পণ্যের বিপিসি পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য (এক্স ইআরএল মূল্য), বিপণন কোম্পানি পর্যায়ে মূল্য (এক্স ডিপো মূল্য) পরিবর্তন হয়েছে। সামিটের কাছ থেকে ফেরত পাওয়া ডিজেল এরই মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে। দেশের ডিজেলের চাহিদা থাকায় বিপিসি সামিট থেকে ৩,০৮,৯৩,৭১৯ লিটার ডিজেল সরবরাহ না নিলে দেশের চাহিদা পূরণের নিমিত্তে সমপরিমাণ ডিজেল বিপিসি বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতো। রাশিয়া-ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী ডলার সংকট ও বৈশ্বিক বিশেষ পরিস্থিতিতে সামিটের প্ল্যান্ট থেকে সংগৃহীত ডিজেল সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। উভয় সংস্থার কেউই যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিবেচনায় বিপিসি গৃহীত ডিজেলের বিদ্যমান বিক্রয়মূল্য হতে বিপিসি/বিপণন কোম্পানি ও স্থানীয় পর্যায়ে যেসব ব্যয় রয়েছে এবং প্রযোজ্য ভ্যাট, উৎস কর, পরিশোধ সাপেক্ষে সবার সম্মতিতে ডিজেলের মূল্য নির্ধারণ/পরিশোধে একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এসব ডিজেল ক্রয়ে বিপিসির ১২৫ কোটি টাকা গচ্চা যেভাবে

মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এসব ডিজেলের মূল্য নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা সিদ্ধান্তে দেখা যায়, বিপিসি সামিটের প্ল্যান্ট থেকে সংগৃহীত ডিজেলের মূল্য ডিজেলের ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় মূল্য ১০৯ টাকা/লিটার থেকে লিটারপ্রতি ব্যয়িত খরচ (ভ্যাট ১৩.২৩ টাকা+ সমান পরিবহন ভাড়া ০.৯০ টাকা+ ফাইন্যান্সিং চার্জ ১.৯৮ টাকা, মোট ১৬.১১ টাকা) বাদ দিয়ে প্রাপ্ত মূল্য (১০৯.০০-১৬.১১)= ৯২.৮৯ টাকা/লিটার-এর ওপর ৭ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করে লিটারপ্রতি মূল্য পরিশোধ করবে। বিপিসি তেলের মূল্যবাবদ প্রদেয় সমুদয় অর্থ পিডিবি ও কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা করবে।

এরপর ১৮ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের প্ল্যান্ট থেকে বিপিসির অনুকূলে গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে সরবরাহ করা ৩,০৮,৯৩,৭১৯ লিটার ডিজেল করপূর্ব মূল্য ৯২,৮৯০ টাকা/কিলোলিটার এবং মূসক করপূর্ব মূল্যের ১৫ শতাংশ হিসেবে ১৩,৯৩৩.৫০ টাকা/কিলোলিটারসহ কর-উত্তর মূল্য ১,০৬,৮২৩.৫০ টাকা/কিলোলিটার হিসেবে দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের করপূর্ব মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯২ টাকা ৮৯ পয়সা। এরই মধ্যে উৎসে কর কর্তন করে অবশিষ্ট টাকা এসক্রো অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়েছে বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছে বিপিসি।

অন্যদিকে ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সামিটকে যখন ডিজেল সরবরাহ করা হয় তখন ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেলের মূল্য ছিল লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে এ দামে ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল বিক্রি করে আসছিল বিপিসি। ডিজেলের দর নির্ধারণ ও সমন্বয়ের জন্য ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ওই ডিজেলের করপূর্ব মূল্য নির্ধারণ করা ছিল লিটারপ্রতি ৫২ টাকা ১৮ পয়সা। ওই হিসাবেই সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানিতে ডিজেল সরবরাহ করে বিপিসি। সে হিসাবে সামিটের ফেরতকৃত ডিজেলে করপূর্ব মূল্যের হিসাবে বিক্রিত মূল্যের চেয়ে প্রতি লিটারে ৪০ টাকা ৭১ পয়সা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে বিপিসিকে। এতে শুধু করপূর্ব মূল্যের হিসাবে ৩ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৯ লিটার ডিজেল ফেরত নিয়ে বিক্রির মূল্যের চেয়ে ১২৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬ টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে বিপিসিকে।

অন্যদিকে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাজারে ৬৫ টাকা লিটারে ডিজেল বিক্রি হতো। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ডিজেলের করপূর্বমূল্যের সঙ্গে মূসক, ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক, বিপণন কোম্পানিগুলোর মার্জিন, সমান পরিবহন ভাড়া, বিপিসির উন্নয়ন তহবিল খাতের ব্যয় যুক্ত করে এক্স ডিপোমূল্য নির্ধারণ করা ছিল লিটারপ্রতি ৬২ টাকা ৮১ পয়সা।

২০২২ সালের ২৯ আগস্ট সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যাবতীয় খরচ ও করপ্রদানসহ ডিজেলের এক্স-ডিপো মূল্য রয়েছে ১০৫ টাকা ৪৩ পয়সা। তাতেও প্রতি লিটারে ৪২ টাকা ৬২ পয়সা বেশি। তবে সামিটের ডিজেল ফেরত নিয়ে গত ১৯ জানুয়ারির জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কর-উত্তর মূল্য পড়েছে ১০৬.৮২৩৫ টাকা। যেহেতু এসব তেল সামিটের ট্যাংক থেকে গোদনাইল এবং ফতুল্লায় বিপণন কোম্পানির ট্যাংকে সরবরাহ করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও এক্স-ডিপো মূল্যের চেয়ে প্রতি লিটারে ১.৩৯৩৫ টাকা বেশি গুণতে হয়েছে বিপিসিকে।

বিশ্লেষকদের মত

ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকার জ্বালানি তেল সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে। এ ধরনের তেল ফেরত দিতে হবে। বেচাকেনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের টাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করা যাবে না। বেশি দামে কেনার এ পুরো প্রক্রিয়াটা অবৈধ।

বিপিসি যা বলছে

কম দামে বেচে বেশি দামে কেনাসহ সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, সামিট থেকে নেওয়া ডিজেলের দর নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। আমি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও ছিলাম না। তবে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উৎসে কর কর্তন করে ডিজেলের মূল্য এরই মধ্যে এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়েছে।

ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।