সংকোচনমূলক বাজেট দেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:২১ এএম, ১১ মার্চ ২০২৪
প্রতীকী ছবি

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংকোচনমূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি কম রাখা এবং বৈদেশি ঋণ কম নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।

রোববার (১০ মার্চ) রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক বাজেট আলোচনায় তারা এ অভিমত দেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনসহ আরও বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় কী কী পরামর্শ পেলেন? উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পরামর্শ খুবই ভালো, আমরা রাইট ট্র্যাকে আছি। সবাই প্রশংসা করেছেন। আমি তো কখনো বলি না সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা অনেক প্রশংসা পেলাম ওদের কাছ থেকে। ওনারা বলেছেন- আপনারা ট্যাকেল করছেন ভালো। কী কী সমস্যা আছে সবাই জানেন, ওনারা বললেন ওনাদের মতো। এখনো পর্যন্ত সব ভালো, কিন্তু ভবিষ্যতে তো আপনাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত ভালো আছে, তবে আপনাদের চেষ্টা করতে হবে।’

সময় শেষ হয়ে আসছে বলতে কী বুঝিয়েছেন? সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সময় শেষ হয়ে আসছে বলতে যে রিফর্মগুলো দরকার, সেগুলো করতে হবে। বিভিন্ন ফিল্ডের রিফর্ম করতে হবে না।’

প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সেই তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না? সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘কর্মসংস্থান হচ্ছে না কে বললো। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জের যে সমস্যা সেটা তো চলমান আছে, সেটা তো এখনো শতভাগ হয়নি। কিন্তু হবে।’

বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বলেছি এখন আমাদের মূল ইস্যু হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। খালি সামষ্টিক সূচক দেখলে লাভ হবে না বা গ্রোথ দেখলে হবে না। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজন হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ান। আমরা অনেক সময় বড় বড় প্রকল্প নেই, এর ফল আসতে অনেক সময় লাগে। এগুলো একটু কমিয়ে দেওয়া। তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে।’

তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স বাড়াতে হবে। প্রত্যক্ষ কর। পরোক্ষ বা ভ্যাটের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো আর ট্যাক্স নেট বাড়ানো। রাজস্ব বাড়াতে হবে। আর বরাদ্দ যেটা হলো অপচয় যেন কম হয়। বরাদ্দ যেন প্রাধিকার ভিত্তিতে হয়।’

অর্থমন্ত্রী কী বলেছেন? সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উনি বলেছেন আমরা এগুলো দেখবো। কতটুকু আপনাদের সাজেশন নিচ্ছি, আমরা আবার যখন বসবো আপনাদের জানাবো।’

আরও পড়ুন
মুখ থুবড়ে পড়েছে এডিপি বাস্তবায়ন, একযুগে সর্বনিম্ন 
মশা মারতে দামামা বাজাচ্ছে দুই সিটি, বাজেট ১৬৮ কোটি 

তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি ঘাটতি কম রাখেন। বৈদেশিক ঋণ একটু কম করেন। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। গভর্নর ছিলেন, উনি বলেছেন আমরা চেষ্টা করছি।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত সুদের হার দিয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সুদের হার বাড়ালে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করলে সাফার করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এমনিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয় না। এর মধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করলে তারা আরও সাফার করবে।’

আলোচার বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কর আদায় বাড়ানোর ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু সিপিডি না, এখানে যারা অন্য অর্থনীতিবিদরা ছিলেন প্রত্যেকে বলেছেন- কর আদায় ব্যবস্থা অটোমেটেড করতে হবে, একটা প্রযুক্তিগত। এই অটোমেটেডটা ম্যানুয়ালি অটোমেটেড হলে হবে না। দেখা যাচ্ছে অটোমেশন কিছু কিছু হয়েছে, কিন্তু এখানে হিউম্যান ইন্টারফেয়ার থাকে। যার জন্য ট্যাক্স সিস্টেমটার সমস্যা দূর করতে পারছি না। এটার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা।’

তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স নীতিমালা প্রণয়ন এবং ট্যাক্স আদায় করা- এ দুটিকে আলাদা করতে হবে। আর একটা বিষয় হচ্ছে ট্যাক্স কর্মকর্তাদের ট্যাক্স আদায় করার জন্য অফিসারদের ওপর এত বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে একজনই নিজের ইচ্ছাতে অনেক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই ক্ষমতাকে একটু কমিয়ে দেওয়া।’

বাজেটের আকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে? এমন প্রশ্নে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাজেটের আকার নিয়ে কয়েকজন মতামত দিয়েছেন। আমাদের পরামর্শ হলো একটু সংকোচনমূলক করা। খরচটাকে একটু কমিয়ে আনলে ভালো। কারণ, মূল্যস্ফীতির একটা চাপের মধ্যে রয়েছি। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সেখানেও একটা চাপ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে কিছুটা কমিয়ে আনা বিশেষ করে প্রশাসনিক ব্যয়, পরিচালন ব্যয় এগুলো যতটা কমিয়ে আনা যায়। অপচয় রোধ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কর কাঠামোটা পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। ৭০ শতাংশের ওপরে কর পরোক্ষ। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হবো, ততোক্ষণ পর্যন্ত এই যে কর ব্যবস্থার মধ্যে একটা আনইকুয়াল ব্যবস্থা হচ্ছে সেটা দূর হবে না। বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে, তখনো তো আমরা এত উচ্চ আমদানি শুল্ক রাখতে পারবো না। আমরা যে বিভিন্ন খাতের ওপর ক্যাশ ইনসেনটিভ দিচ্ছি, এটাও থাকবে না তখন। এগুলোকে আস্তে আস্তে আমাদের তুলে দিতে হবে।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা দেখছি আমাদের গ্রোথ হচ্ছে, কিন্তু সেভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এই কর্মসংস্থার জন্য বিনিয়োগ দরকার, মানবসম্পদের ওপর বিনিয়োগ দরকার। তাদের শিক্ষার গুণগত মান, এত বেশি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জেলায় জেলায়- কিন্তু তারা তো পাশ করে চাকরি পাচ্ছে না। কাজেই মানবসম্পদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটি খাতেই বরাদ্দ কম। এক শতাংশের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার ফলে স্বাস্থ্য খাতের যে সেবা তার গুণমান কম। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। সেটা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এমনকি নীতি-নির্ধারকরাও চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছেন, যেখানে পারেন। স্বাস্থ্য খাত যদি আমরা আরও উন্নত করি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে না।’

‘প্রবৃদ্ধির ওপর জোর না দিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর জোর দেওয়া উচিত এই বাজেটে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানো। বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে নীতিমালা আছে কিন্তু বাস্তবে সেটা বাস্তবায়ন হয় না। এসব বিষয়ে আমরা কথা বলেছি’, যোগ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।

এমএএস/কেএসআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।