বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন দোকানের কর্মচারী

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৫১ পিএম, ২৪ জুন ২০২০

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। করোনাতে হঠাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় সকল শিক্ষার্থীকে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সন্তান বাড়ি ফেরায় প্রতিটি বাবা-মায়ের মনে দারুণ স্বস্তি মেলে।

অনেকদিন পর সন্তানকে কাছে পেয়ে দিনকাল ভালোই চলছিল কিন্তু অভাবের সংসারে কাজকর্ম সীমিত থাকায় আয়ের পথ যখন বন্ধ হওয়ার পথে, তখন মায়ের মুখের মলিন হাসি আর বাবার চোখের করুণ চাহনি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানের বুঝতে বাকি রইল না যে, অভাবী সংসারে অভাবের হানা পড়েছে।

অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় দু-একটি টিউশনি করে খরচ চালিয়ে নিতেন। কিন্তু বাড়িতে চলে আসায় সে আয়ের পথ বন্ধ হলেও ব্যয় সংকোচিত হয়নি। মোবাইলে ডাটার খরচ, দূরদূরান্ত সহপাঠীদের সাথে সবসময় যোগাযোগ, অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাসে অংশগ্রহণ— সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় বেড়েছে যথেষ্ট। সেইসাথে অর্থের চাহিদাও বেড়েছে দ্বিগুণ।

খরচের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিতে সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তানদের সমস্যা না হলেও ভীষণ বিপদে পড়েছেন দরিদ্র পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানরা। দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারের দুঃখ-কষ্ট কাছ থেকে দেখে অনেকেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কাজ। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের জন্য কে দেবে তাদের কাজ? করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সে চলে যাবে তার প্রাণের ক্যাম্পাসে।

dops-04.jpg

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ডপস সদস্যদের সঙ্গে শাহীন মিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ৪৩ জন ডপস সদস্য আজ একটানা তিন মাসের অধিক সময় ধরে বাড়িতে। বিভিন্নজন বিভিন্ন সমস্যা বিভিন্নভাবে মোকাবিলা করে দিন পার করছেন। তাদেরই একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. আব্দুস ছাত্তার শান্ত। বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। পাঁচ সদস্যের পরিবারে সবার ছোট সন্তান। দারিদ্র্যের কষাঘাতে অন্য দুই ভাই শ্রমিক পেশায় চলে গেলেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ডপস’-এর সহায়তায় তিনি পড়াশোনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাবা রিকশা চালিয়ে সংসার চালালেও বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ। আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। তাই বাড়ির পাশে কাজ নিয়েছেন বাজার পাহারাদারের।

অনেকদিন বাড়িতে থাকার সুবাদে খুব কাছ থেকে বাবার কষ্ট আর সংসারের অভাব-অনটন দেখতে পেরেছেন শান্ত। এই বয়সেও দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন বাবা। রাত জেগে বাজার পাহারাদারের কাজ করে যাচ্ছেন। বাবার দীর্ঘদিনের ক্লান্তিভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আর সহ্য করতে না পেরে তাৎক্ষণিক কাজের খুঁজে বের হয়ে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শান্ত।

কাজের খোঁজে ফোন দেন পরম স্বজন ও বড় ভাই, দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থী উন্নয়ন সংস্থা- ডপস’র প্রতিষ্ঠাতা সৈনিক শাহীন মিয়াকে। ফোন দেন স্থানীয় সাংবাদিক মজিদ ভাইকেও। একটা কাজ তার খুব জরুরি। সেটা দোকান কর্মচারী অথবা হেটেলবয়, যা-ই হোক না কেন! কোনো কাজ না পেলে একটা অটোরিকশা ভাড়া করে দেয়ার আবদার করেন।

dops-04.jpg

অবশেষে একটি কাজ জোটে, দোকান কর্মচারীর। বেতন যা-ই দিক, অন্তত খাওয়াটা তো চলবে। কারণ বাড়ির খবর… জাগো নিউজকে বলেন শান্ত।

ডপস’র প্রতিষ্ঠাতা শাহীন মিয়া বলেন, শান্ত আমাকে ফোন দিয়েছিল, যেভাবেই হোক একটি কাজ ম্যানেজ করে দেয়ার জন্য। প্রথমে বিষয়টা নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু বারবার বলার পর বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তারপর তার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখি পাশাপাশি সামান্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই।

“এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন তার ফোন, ‘ভাই, আমি একটা দোকানে কাজ পেয়েছি।’ আমি জানতে চাইলাম, বেতন কত। সে বলল, ‘ভাই, বেতন যাই দিক না, অন্তত খাওয়াটা তো চলবে। কারণ বাড়ির খবর…, আপনি ভালো করেই জানেন’।”

শান্তর জীবন সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে শাহীন মিয়া আরও বলেন, ‘এই সেই শান্ত যে দর্জির দোকানে এবং অন্যের চায়ের বা রুটির দোকানে কাজ করে পড়ালেখা করত। বিভিন্ন সমস্যায় যখন পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার উপক্রম তখন পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন- ডপস।’

dops-04.jpg

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর টিউশনি আর কিছুটা সহযোগিতায় চলছিল তার শিক্ষা-জীবন। করোনার করুণ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় লম্বা ছুটিতে দীর্ঘদিন নিজ বাড়িতে অবস্থান করায় পরিস্থিতি বাধ্য করেছে দোকান কর্মচারীর কাজ নিতে। এতে অভাবের সংসারে সামান্য হলেও যে আলোর দিশা পায়।

সমাজের সামর্থ্যবান লোকদের বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়ে শাহীন মিয়া আরও বলেন, ‘আপনার আশেপাশে দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে অবস্থান করছে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা চক্ষুলজ্জায় প্রয়োজনীয় অনেক কথাই বলতে পারছেন না। আসুন তাদের দিকে মানবিক মন নিয়ে গোপনে সহযোগিতার হাত বাড়াই। তাদের চলার পথকে সহজ করে দেই। মনে রাখবেন, আপনার আমার সামান্য সহযোগিতায় যারা একটু স্বস্তিতে চলতে পারবে তারা যখন বড় বড় কর্মকর্তা হবে তখন এই দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়ানোর কথা মনে করে হাজারও অসহায় মানুষের প্রতি তারা সহযোগিতার হাত বাড়াবে।’

এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।