প্রাথমিকের ‘কোটি টাকার’ টিভি ক্লাসের অর্জন তলানিতে

মুরাদ হুসাইন
মুরাদ হুসাইন মুরাদ হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২০

অডিও শুনুন

করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘ঘরে বসে শিখি’ নামে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। স্টুডিওতে শিক্ষকদের নিয়ে ভিডিও ধারণ করা এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক ক্লাস সম্প্রচার হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস তৈরিতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। এ খাতে এখন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় হলেও মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ সুবিধার আওতায় এসেছে।

অনলাইন ক্লাসের ব্যয় অনুযায়ী ফল আসছে না, এজন্য দূরশিক্ষণের ব্যয় কমিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে শিক্ষকদের সম্মানি বাড়িয়ে বাড়তি ক্লাসের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ডিপিই থেকে জানা গেছে, গত তিন মাস ধরে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নিতে গত ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিক স্তরে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার শুরু হয়। স্টুডিওতে শিক্ষকদের মাধ্যমে ক্লাস রেকডিং করে তা টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ে তিন শতাধিক ক্লাস সম্প্রচার হয়েছে। এ বাবদ প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রতি ক্লাসের ভিডিও এডিটিং, স্টুডিও ভাড়া, শিক্ষক, প্রোগ্রামারসহ তাদের সম্মানি বাবদ প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টেলিভিশন ক্লাসের জন্য ডিপিই থেকে ব্যয় বাবদ নিজস্ব বাজেট থেকে বরাদ্দের চিন্তাভাবনা করলেও ইউএনডিপি, ইউনেক্সো ও ইউনিসেফ থেকে এক লাখ ইউএস ডলার (৮৫ লাখ টাকা) অনুদান দেয়ার অঙ্গীকার আসে। বাকি টাকা ডিপিই’র করোনাকালীন বিশেষ ফান্ড থেকে পরিশোধ করা হবে।

তারা বলেন, টেলিভিশনের মতো চলতি মাস থেকে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে রেডিওতে শ্রেণিপাঠ শুরু হবে। এজন্য প্রতি ক্লাস বাবদ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের সাহায্যে ভালো শিক্ষকদের পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা ঘরে বসে ফোন করে পাঠ্যবইয়ের বিষয়ভিত্তিক পরামর্শ নিতে পারবে।

এদিকে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার আগে গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে প্রতিদিন ৬২৫ মিনিট পড়ালেখায় ব্যয় করলেও এখন তারা মাত্র ১২৪ মিনিট পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ালেখার সময় কমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়। সেই হিসাবে ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার।

এছাড়া টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি ফলে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ এ দুটি অনুষ্ঠান দেখছে এবং এক শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। যারা টিভি ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে তারা আবার টেলিভিশনে ক্লাস অনুসরণ করাকে বেশ কঠিন বলে মনে করছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লা জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে আমরা নানা মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রতিদিন টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ক্লাস শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। দ্রুত রেডিও ক্লাস ও ফোনের মাধ্যমে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সংযোগ স্থাপন শুরু করা হবে। দূরশিক্ষণ পাঠের জন্য আমরা ইউএনডিপি, ইউনেস্কো ও ইউনিসেফ থেকে এক লাখ মার্কিন ডলার অনুদান পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছি। সে অর্থ দিয়ে টেলিভিশন পাঠদানের ব্যয় পরিশোধ করা হবে। শুধু শিক্ষকদের সম্মানি অধিদফতরের ফান্ড থেকে দেয়া হবে।

মহাপরিচালক বলেন, সম্প্রচার ব্যয় ফ্রি হওয়ায় এ বাবদ অনেক অর্থ কমে এসেছে। ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকায় আমরা একটি ক্লাস তৈরি করতে পারছি। রেডিও ক্লাসের জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। টিভিতে সম্প্রচার ক্লাসগুলোতে অধিদফতরের ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সংসদ টিভিতে শ্রেণিপাঠ সম্প্রচার করছি, আগামী সপ্তাহ থেকে রেডিওতে ক্লাস সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু করা হবে। এজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাঠদান চালিয়ে রাখতে আমরা এসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব। তাদের ওপর যাতে চাপ সৃষ্টি না হয় সে বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় টেলিভিশনে পাঠদান একটা বিকল্প ব্যবস্থা। এখান থেকে শতভাগ সাফল্য অর্জন করা যাবে, তা বলা যাবে না। তবে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা যেন লিখতে পারে, পড়তে পারে এবং গুনতে পারে, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। অর্থাৎ সে কতটুকু শিখছে সেই মূল্যায়নটা জরুরি।

শিক্ষানীতি- ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, সংসদ টেলিভিশনে ব্যয় ও প্রচার অনুযায়ী আউটকাম আসছে না অর্থাৎ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ করে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আই কন্টাক্ট থাকা দরকার কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রাথমিকে টিভি ক্লাস চলাকালীন অভিভাবকদেরও সন্তানের সঙ্গে বসে থাকতে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, অভিভাবকরা পাশে না থাকলে শিক্ষার্থীরা টিভি ক্লাস করতে চায় না। সেক্ষেত্রে কতজন অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে টিভির সামনে বসবে, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ বাড়িতে একটা টিভি থাকে। সেখানে শুধু শিক্ষার্থীদের ক্লাসের জন্য টিভি-টা সবাই ছেড়ে দেবে, এমনও ভাবা ঠিক নয়। অর্থাৎ শিক্ষামূলক কাজে টিভিটা সবসময় ব্যবহার হচ্ছে না, তাই টিভি পাঠদানেও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সবকিছু স্বাভাবিক হলে অর্থাৎ বিদ্যালয় খোলার পর অবশ্যই শিক্ষাবর্ষ বাড়াতে হবে। এখন টিভি পাঠদান বা রেডিও পাঠদানে খরচটা কমিয়ে স্বাভাবিক সময়ে শিক্ষকদের ইনসেনটিভ (সম্মানি) বাড়িয়ে দিয়ে এবং ছুটি কমিয়ে সে ক্লাসগুলো পুষিয়ে নিতে হবে। এর মাধ্যমে কিছুটা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।

এমএইচএম/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।