সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার না হওয়াই আমাদের বড় ব্যর্থতা

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:১০ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অধ্যাপক আবদুল খালেক। উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য।

বাংলা ভাষার অর্জন ও চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: একটি রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এমন ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সাত দশকে বাংলা ভাষার অর্জন নিয়ে কী বলা যায়?

অধ্যাপক আবদুল খালেক: বাঙালির অর্জনটা ঠিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। আজ এগিয়ে যাওয়ার যে সিঁড়িগুলোতে পা রাখছি, তার শুরু ভাষা আন্দোলনের ওই রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে।

ভাষা আন্দোলনের সময় আমি স্কুলে পড়ি। আন্দোলনে আমরা শরিক হচ্ছি। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছি, মিছিল করছি। অন্যদিকে কৃষক-শ্রমিক-জনতাও আন্দোলন করছে। তাদের দাবি ছিল ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’। পরে বুঝলাম তারাই ঠিক। আমাদের দাবির অর্থ ছিল পাকিস্তানের মধ্যে থেকে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাইছি। আর তারা বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্র চাইছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কৃষক-জনতার দাবিই ঠিক হলো।

আরও পড়ুন>> জাতিসংঘে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

ভাষার জন্য আন্দোলন যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নেবে, তা পাকিস্তান সরকার বুঝতে পারেনি। আমরা অর্জনের সমস্ত পথ সেখান থেকেই রচনা করেছি। আজ আমরা কোথায়, পাকিস্তান কোথায়! পাকিস্তান তো দেউলিয়া হয়ে গেলো। আমরা এক সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাবার দিতে পারিনি। এখন ১৮ কোটি মানুষ না খেয়ে থাকছে না। এক এক বিঘা জমিতে ৩০ মণ ধান ফলসে। সবই তো মানুষের অর্জন। বাঙালির অর্জন। আমাদের অর্জন মূলত ভাষাকেন্দ্রিক দেশ হওয়ার কারণেই।

জাগো নিউজ: আপনি নানা অর্জনের কথা বলছেন? বাংলা ভাষার উন্নয়ন-গবেষণা নিয়ে কোথায় যেতে পারলাম?

আবদুল খালেক: বাংলা ভাষার উন্নয়ন আশানুরূপ হয়নি, এটি নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করছি। বাংলা ভাষার সর্বত্র ব্যবহার না হওয়াই আমাদের বড় ব্যর্থতা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা ছিল। এতদিনেও আমরা তা পারিনি। এখনো আদালত ইংরেজিতে রায় দেন।

জাগো নিউজ: করণীয় কী?

আবদুল খালেক: আমাদের অনুবাদে আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। আমি চীনে পড়াশোনা করেছি। তারা কিন্তু খুব ভালো ইংরেজি জানে না। চীনা ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক নিম্মমানের। তাদের বাংলা ভাষার মতো আলাদা অক্ষর নেই। অথচ আমরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছি না।

জাগো নিউজ: এই ব্যর্থতা নিয়ে কাকে দায়ী করা যায়?

আবদুল খালেক: আমরা সবাই এর জন্য দায়ী। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন অনুবাদ শাখা করতে পারলাম না। অনুবাদের জন্য অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

জাগো নিউজ: আপনি নিজেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। আপনি উদ্যোগ নিতে পারতেন?

আবদুল খালেক: অর্থের প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা অপ্রতুল বলে মনে করি। অনেকটাই ‘নুন আনতে পানতা ফুরানো অবস্থা’।

আরও পড়ুন>>‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বায়নের পথে এগোতে পারেনি’

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাজেটের ৭শ শতাংশ শিক্ষাখাতের জন্য। এখন দুই শতাংশও দেওয়া হয়। এ দিয়ে তো আপনি আশানুরূপ উদ্যোগ নিতে পারেন না।

জাগো নিউজ: কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো উন্নয়ন হচ্ছে। উঁচু উঁচু ভবন করা হচ্ছে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। অথচ বাংলা ভাষার উন্নয়নে একটি অনুবাদ শাখা খোলা গেলো না!

আবদুল খালেক: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চেয়ে এই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি ছিল বাংলা একাডেমির। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা আছে বটে। কিন্তু অনুবাদটা বাংলা একাডেমি থেকে হওয়া দরকার।

জাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি যা করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বাংলা একাডেমি করতে না পারা নিয়ে আপনার অভিমত কী?

আবদুল খালেক: এই প্রশ্নের জবাব বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ভালো দিতে পারবেন। কাজটা তাদের। এই প্রশ্নের জবাব আমি ভালো দিতে পারবো না।

জাগো নিউজ: সর্বত্র ব্যবহার করতে না পারায় বাংলা ভাষার জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়ছে কি না?

আবদুল খালেক: বাংলা ভাষার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে আমাদের দুর্বলতার কারণে। ভাষার দুর্বলতার কারণে এমন হচ্ছে না। আমি যেভাবে সহজে কথা বলতে পারি, চীনা ভাষায় তা পারা যায় না। অথচ, চীনা ভাষার প্রভাব বাড়ছে।

আরও পড়ুন>> সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কি দুরাশা?

আবার আমরা যে একেবারে পারছি না, তাও নয়। এক সময় তো কম্পিউটারের ভাষা বাংলা ছিল না। এখন কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাপকহারে হচ্ছে। এরপরেও আমি বলবো, বাংলা ভাষার সর্বত্র ব্যবহার নিয়ে আমাদের যথেষ্ট রকমের ব্যর্থতা আছে। এর জন্য বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। শ্রদ্ধা থাকতে হবে।

জাগো নিউজ: মিডিয়ায় বাংলা ভাষার উপস্থাপন, বিকৃতি ব্যবহার নিয়ে অনেকেই হতাশ বা সমালোচনা করছেন। আদৌ কি হতাশা হওয়ার মতো?

আবদুল খালেক: এই প্রশ্নে আমি উদার হতে চাই। সংস্কৃতির কাছে বাংলা ভাষার অনেক ঋণ আছে। সেনরা এসে সংস্কৃতকে রাষ্ট্র ভাষা করেছিল। আমরা চাকরির জন্য সংস্কৃতি ভাষা শিখেছিলাম। মুসলমানরা এসে ফার্সিকে রাষ্ট্র ভাষা করলো। ফার্সি শিখলাম কাজের জন্য। একইভাবে ইংরেজি, উর্দুও শিখলাম। কিন্তু বাংলা ভাষাকে তো বিসর্জন দেইনি। সংস্কৃত মরে গেছে। বাংলা বেঁচে আছে। সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল। এ কারণেই মরেছে। আমি যদি রাজশাহী রেল স্টেশন থেকে রিকশা চালককে বলি, ‘নওহাটা যাবে?’। সে সহজেই বুঝবে। কিন্তু সংস্কৃত পণ্ডিত যদি এসে বলেন যে ‘নবহট্টে যাইবো’। সে তো বুঝবে না। সাধারণ মানুষ ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখে নানাভাবে।

আরও পড়ুন>> বাংলা ভাষার ভবিষ্যত : ভাবনা-দুর্ভাবনা

চার-পাঁচ হাজার বিদেশি ভাষা বাংলা ভাষায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এগুলো যে বিদেশি, তা বোঝার উপায় নেই এখন। এটি বাংলা ভাষার সার্থকতা। টেলিফোনকে তো আপনি এখন দূরালাপনী বলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। বাংলা একাডেমির ‘একাডেমি’ শব্দ তো ইংরেজি। মিশে গেছে বাংলার সঙ্গে। বাংলা ভাষা রক্ষণশীল নয়, বলেই সমৃদ্ধ হচ্ছে। হতাশ হওয়ারও কোনো কারণ নেই।

এএসএস/এএসএ/এএসএম

আমি চীনে পড়াশোনা করেছি। তারা কিন্তু খুব ভালো ইংরেজি জানে না। চীনা ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক নিম্মমানের। তাদের বাংলা ভাষার মতো আলাদা অক্ষর নেই। অথচ আমরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছি না

আমরা চাকরির জন্য সংস্কৃতি ভাষা শিখেছিলাম। মুসলমানরা এসে ফার্সিকে রাষ্ট্র ভাষা করলো। ফার্সি শিখলাম কাজের জন্য। একইভাবে ইংরেজি, উর্দুও শিখলাম। কিন্তু বাংলা ভাষাকে তো বিসর্জন দেইনি। সংস্কৃত মরে গেছে। বাংলা বেঁচে আছে। সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল। এ কারণেই মরেছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।