গবেষণা
প্রাথমিক-মাধ্যমিকে পারিবারিক শিক্ষাব্যয় বেড়েছে

২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে পারিবারিক শিক্ষার ব্যয় আগের বছরের তুলনায় প্রাথমিক স্তরে বার্ষিক ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
শনিবার (৩০ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর সিরাডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে বিদ্যালয়ের শিক্ষা: মহামারি উত্তর টেকসই পুনরুত্থান’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এডুকেশন ওয়াচ এই তথ্য জানায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে একজন শিশুর শিক্ষার জন্য বার্ষিক পারিবারিক গড় ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ৮৮২ টাকা। যেখানে গ্রাম ও শহরে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। একই সময়ে মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবারের ব্যয় ছিল ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। এই দুই স্তরে প্রধানত ব্যয় হয়েছে প্রাইভেট টিউটরের বেতন ও গাইডবই-নোটবই বাবদ।
অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক ও গবেষক দলের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি জানান, গবেষণায় সারাদেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলার মধ্যে থেকে ২৬টি উপজেলা ও পাঁচটি সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া গবেষণার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট সাত হাজার ২২৫ জন কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৪১ শতাংশ অভিভাবক এবং মাধ্যমিক স্তরে ১৭ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, প্রতি সন্তানের জন্য তাদের মাসিক ব্যয়ের সামর্থ্য ছিল দুই হাজার টাকার মধ্যে। এটি ২০২২ এবং ২০২৩ সালের গড় ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিক্ষার্থীরা উপার্জনের মাধ্যমে তাদের পারিবারে আর্থিক অবদান রাখে, যা তাদের ঝরেপড়ার কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকেই নির্দেশ করে। ঝরেপড়ার কারণসমূহ দূর করতে এবং স্কুলে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে স্কুলের লেখাপড়ার মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে এবং তা পরিবারের জন্য সাশ্রয়ী হতে হবে।
গবেষণায় উপস্থাপিত তথ্য বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মহামারির পরে তাদের নতুন শ্রেণির পাঠ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধায় ছিল।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের সহায়তা নিয়েছে বা কোচিং সেন্টারে গিয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের কাছ থেকে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এই নির্ভরতার হার ছিল যথাক্রমে ৯২ ও ৯৩ শতাংশ।
প্রাথমিক পর্যায়ের ৪১ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ৫৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জানিয়েছে তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আট শতাংশ ও মাধ্যমিকের ১৭ শতাংশ স্কুলের কাজে বা লেখাপড়া সংক্রান্ত কাজে ইন্টারনেটের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং (অনলাইন ও সশরীরে)’ পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া এবং মাদরাসায় স্থানান্তরের বিষয়টি উঠে আসে। গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয় ছাড়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঝরেপড়া মহামারির জন্য প্রভাবিত। এজন্য যে কারণগুলো উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে- মহামারির কারণে নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোর আরও কমে যাওয়া, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য অভিভাবকদের খরচ বৃদ্ধি, মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং বিদ্যালয় থেকে যথাযথ নির্দেশনার অভাব।
ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের জানতে চাওয়া হয় তারা বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী কি না- জবাবে প্রাথমিক স্তরে ৫৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী নয়। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীরা বর্তমানে কী করে সেটিও জানার চেষ্টা করা হয়েছে এই গবেষণায়। তাতে প্রাথমিক স্কুল বয়সী শিশুদের ৪১ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের ৪৯ শতাংশ বলেছে তারা কাজ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরেপড়া মেয়ে শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। একটি ছোট অংশ বলেছে, তারা গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত এবং অন্যরা বলেছে তারা কিছুই করছে না।
স্কুল এবং শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শনের তথ্য
মৌলিক মানদণ্ড প্রয়োগ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক শ্রেণিকক্ষের অবস্থা ভালো পাওয়া গেছে। যেখানে মাধ্যমিক স্তরের ভালো বিদ্যালয় ৫৭ শতাংশ। শ্রেণিকক্ষের অবস্থা নির্ধারণের ন্যূনতম বাপ মৌলিক মানদণ্ড হিসেবে প্রাকৃতিক আলো বাতাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা ও নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়েছিল। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ধারণক্ষমতা বোঝার জন্য শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্রের পর্যাপ্ততা দেখা হয়েছিল। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লম্বা বেঞ্চ এবং ডেস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। যেখানে এক সারিতে চারবার পাঁচজন শিক্ষার্থী একদিকে মুখ করে বসে।
গবেষণা বলা হয়, বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (৬৯ শতাংশ) শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের ধরন ভালো আর ২৬ শতাংশ ভেতরে মোটামুটি ভালো লক্ষ্য করা গেছে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৬৭ শতাংশ) মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো আর এক পঞ্চম অংশ (২১ শতাংশ) বিদ্যালয়ে মোটামুটি ভালো যোগাযোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। সমীক্ষায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণ করা প্রায় অর্ধেক শ্রেণিকক্ষে (যথাক্রমে ৪৬ শতাংশ এবং ৫১ শতাংশ) শিক্ষকের ভালো পাঠ ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা গেছে।
সুপারিশ
উপরোক্ত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঝরেপড়া ও শিক্ষাবঞ্চিতদের ফিরিয়ে আনা, শিক্ষকদের সহায়তা ও প্রণোদন প্রদান, শ্রেণিকক্ষে শিখন ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি, পারিবারিক সহায়তা এবং শিক্ষাব্যয়ের বোঝা কমানো, আইসিটি ভিত্তিক শিখন এগিয়ে নেওয়া, ব্লেন্ডেড পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং জাতীয় পর্যায়ে অনুকূল নীতিমালা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন সুপারিশ করা হয়।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক এবং এডুকেশন ওয়াচের সদস্যসচিব রাশেদা কে. চৌধুরীর সঞ্চলনায় সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী। এতে সমাপনী বক্তব্য দেন এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ড. কাজী খালিকুজ্জামান আহমেদ।
এ সময় গবেষণা দলের সদস্য ড. মনজুর আহমদ, ড. সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম উপস্থিত ছিলেন।
এনএস/ইএ/জেআইএম