পথশিশুদের আক্ষেপ

ঈদের দিন আমাদের কেউ দেখতেও আসে না

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:২৩ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২৪

মিরাজ উদ্দিন
কমলাপুর রেলস্টেশন দিয়ে যখন সবাই প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ফিরছেন। ঠিক সেখানে কিছু মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে একবুক আফসোস নিয়ে। কারণ অনেকের নেই কোনো বাড়ি কিংবা পিতামাতা অথবা নেই কোনো ধর্মীয় পরিচয়। ঈদের দিন একটা নতুন জমা কিনে গায়ে পরার মতো ভাগ্যে জুটছে এই পথশিশুদের। প্রতি বছরের বাড়ছে এর সংখ্যা।

হাসান নামের এক পথশিশু, বয়স আনুমানিক ১৪ হবে। হাসান এই স্টেশনেই থাকে। সবার বাড়ি যাওয়া দেখে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। অবশেষে হর্ন দিয়ে চলে গেল ট্রেন কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলো হাসান। জন্মের পর মাকে কখনো দেখেনি। ভালোবাসা তো সেটা দূরের কথা। স্টোক করে বাবাও মারা গেছে ২ বছর আগে। কীভাবে আসলেন এই জায়গায় বলতে পারেন না। কোনো আত্মীয় স্বজনদের পরিচয় ও জানেন না। বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর দেখছে ছিন্নমুল জায়গায় তার বাসস্থান। এই ফুটপাতে তার ভালো লাগে না। সুন্দর একটা জীবন চাই। কেউ যদি আমাকে সন্তানের মতে আগলে রাখতো আমি খুশি হতাম।

ঈদে সবাই বাড়ি যাচ্ছে আমার তো মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। থাকলে আমিও যেতাম, কেউ তো আমাকে নিচ্ছে না। ঈদের দিন সবার বাবা মা কত আদর করে আর আমাদেরকে কেউ দেখতেও আসে না। এইকথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসান। জন্মের পর মানুষের গালি আর বকা শুনতে শুনতে এই পর্যন্ত এসেছি। মানুষ আমাদের কেন জানি মানুষ মনে করে না।আমরা কি ভিন্ন জগতের কেউ। কোথাও কাজ করবো সেটাও পাচ্ছি না,বলে ছোট মানুষ তোমার এখনো আঠারো বছর হয় নাই জন্মনিবন্ধন লাগবে। কোথায় পাবো?

আরও পড়ুন

হাসানের মতো হাজারো গল্প আছে এই কমলাপুর রেলস্টেশনে। কারও বাবা মা নেই। নেই কোনো পরিচয়। সেজন্য ঈদে বাড়ি যেতে পারছেন না। কিন্তু রাকিবের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। তবুও সে কোথাও যাচ্ছে না। এর পেছনে আছে হৃদয় বিদায়ক গল্প। একযুগের বেশি সময় ধরে এই কমলাপুর রেলস্টেশনে আছেন তিনি। ছোটবেলায় পরিবারের অবাধ্য হয়ে চলতেন তিনি। কারও কথা শুনতেন না। সিগারেট সহ বিভিন্ন মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন এই শহরে।

মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে ২ মাস আগে। বাড়িতে চলে আসবে বলার পর মা বলছে আসা লাগবে না, তুই সেখানে থাক বাড়িতে তোর কোনো জায়গায় নেই। মাকে বললাম ঈদের একটা দিনের জন্য আমাকে থাকতে দেন। মা না করে দিল।

ঈদের দিন কি করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে রাকিব বলেন সারাদিন কান্নাকাটি করি। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আমার দুঃখ একজায়গায় কারণ আমার আশপাশের যারা আছে তাদের কারও বাবা অথবা মা কিংবা আত্মীয়-স্বজন নেই। কিন্তু আমার তো আছে এরপরও আমাকে এই ফুটপাতে থাকতে হয়। শীতের সময় অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে গেলে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমাতে হয় অনেক সময় এম্নেই শুয়ে থাকি। অসুস্থ হলে দেখার কেউ থাকে না।

পরিবারের অযত্নের কারণে নষ্ট হয়ে যায় একটি ফুটন্ত গোলাপের মতো জীবন। তেমনি হয়েছে নোয়াখালী হাতিয়া নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের সিডিএসপি বাজারের ৭নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিমের ছেলে রিয়াজ উদ্দিনের পরিবার পরিজন রেখে বেছে নিয়েছে এই কমলাপুর রেলস্টেশনের ফুটপাত। ২ বছর আগে এখানে এসেছে আর ফেরা হয়নি। কেন এই পথ বেছে নিয়েছেন শোনালেন সেই গল্প।

এলাকায় বিভিন্ন ফল আম, ডাব ইত্যাদি চুরি করতেন। একপর্যায়ে আর আম, ডাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ঘরে টাকা পয়সা চুরি করতে শুরু করেন। এইজন্য পরিবার মারধর করতো খুব। এছাড়া বাজার থেকে রাত ১২ টার পর ফিরতেন সিনেমা দেখে। গভীর রাতে বাড়িতে গেলে ঘরে ঢুকতে দিতো না। এভাবে ধীরে ধীরে পরিবারের প্রতি মন উঠে যায়। মাথায় চিন্তায় আসলো বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।

একদিন এক পরিচিত লোক তাকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়েছে বাজার করে আনতে। এই সুবর্ণ সুযোগ সেই টাকা নিয়ে ঢাকা রওনা দিলেন। ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে এক হাজার টাকা লঞ্চে খরচ করলেন। সকালে সদরঘাট থেকে হেঁটে হেঁটে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে আসেন। তখন থেকেই এখানে।

রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা নেই শুধু ঈদ আসলে বাড়ির কথা মনে পড়ে। কারণ চোখের সামনে সবাই বাড়ি যাচ্ছে ছেলেমেয়েকে নিয়ে। এই দৃশ্য দেখে একটু মন খারাপ হয়। কল দিলে মা কান্নাকাটি করে তাই কল দেই না। আমরা ভাই বোন তিনজন আমার বড় ভাই ও সেইম আমার মতো কিছু দিন বাড়িতে থাকে আবার বিভিন্ন ফুটপাতে থাকে। এখন কোথায় আছে জানি না। আমার এই জগতে ভালো লাগে। এখানকার সবাই আমার আপনজন।

৮ বছরের আলিফ থাকে কমলাপুর রেলস্টেশনে। আর মা মতিঝিল ফুটপাতে থাকে ছোট্ট বোন নিয়ে। রমজানের আগে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর দেখা করতে যায়নি। কেমন আছে মা অথবা সন্তান কেউ কারও সম্পর্কে জানেন না। কয়েক মিনিটের দূরত্ব। বাবা আছে কি না তা-ও জানে না আলিফ। ঈদের দিন যাবে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।

আরও পড়ুন

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।