মি. বিন : নির্বাক ছবির জাদুকর

মাহবুবর রহমান সুমন
মাহবুবর রহমান সুমন মাহবুবর রহমান সুমন , ফিচার কন্ট্রিবিউটর
প্রকাশিত: ১১:৩৪ এএম, ০৮ জানুয়ারি ২০১৭

মি. বিন নামটি শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে হয়তো হাতেগোনা কয়েকজন হবে। কেননা একজন অভিনেতা তার অভিনয় ক্ষমতার মাধ্যমে এই নামটিকে তৈরি করেছেন ব্র্যান্ড হিসেবে। আর এই ব্র্যান্ডের আড়ালে সেই অভিনেতার যে আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে, তা হচ্ছে রোয়ান অ্যাটকিনসন। হ্যাঁ, আপনি যাকে মি. বিন নামে চেনেন তার আসল নাম রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন। ১২ বছর পর্যন্ত নিজের চোখে টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়নি তার। তবে বর্তমানে যেসব শিল্পী নির্বাক ছবিতে অভিনয় করে সবাক যুগের মানুষকে অবাক করে যাচ্ছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

গত ৬ জানুয়ারি ছিল মি. বিন খ্যাত রোয়ান অ্যাটকিনসনের জন্মদিন। তাই নির্বাক ছবির জাদুকরী এই অভিনেতাকে নিয়ে জাগো নিউজের আজকের আয়োজন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমন

পরিচিতি
bean

১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের ডুরহাম বিভাগের কনসেটে জন্মগ্রহণ করেন মি. বিন। তার পুরো নাম রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন হলেও ডাক নাম রো। তার বাবার নাম এরিক অ্যাটকিনসন এবং মায়ের নাম এলা মে। তার বাবা এরিক অ্যাটকিনসন একজন কৃষক এবং একটি কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মি. বিন। ১৯৯০ সালে মেকআপ আর্টিস্ট সুনেত্রা শাস্ত্রীকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসারে রয়েছে দুটি সন্তান- বেন এবং লিলি।

অন্যদিকে মি. বিন একজন ব্রিটিশ লেখক এবং কমেডিয়ান। তবে তিনি সুপরিচিত মি. বিন, ব্যঙ্গরচনা এবং স্কেচ শোর জন্য। রুপালি পর্দার মতো বাস্তবেও রোয়ানকে সবাই ভাবেন হাসি-খুশি একজন মানুষ। আসলে ব্যক্তিগত জীবনে রোয়ান খুবই চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে তার মোটেও ভালো লাগে না। আর কথা কম বলতে পছন্দ করেন বলেই হয়তো মি. বিন চরিত্রে এর প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া অ্যাটকিনসন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনার জন্য পরিচিত। তিনি যুক্তরাজ্যের ধর্মসংক্রান্ত একটি আইনের ত্রুটি আছে বলে ঘোষণা করেন।

শিক্ষাজীবন
bean

মানুষ হাসানোর এই কারিগর পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা করেছেন ডারহ্যামের কোরিস্টার্স স্কুলে। এরপর সেন্ট বিস স্কুলে। ১৯৭৫ সালে তিনি নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কুইন্স কলেজ থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ফেলো ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া স্কুল-কলেজগুলোতে তিনি  নিজের প্রতিভার জানান দিয়ে আসছিলেন। মি. বিনের স্কুলসঙ্গী ছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। টনি ছিলেন গম্ভীর কিন্তু রোয়ান আমুদে আর রসিক হলেও দু’জনের মধ্যে ছিল খুব ভালো বন্ধুত্ব।

অভিনেতা হয়ে ওঠা
bean

মি. বিন ছোটবেলায় কথা খুব কম বলতেন, তবে বেশ হাসিখুশি থাকতেন। তিনি যখন স্কুলে পড়তেন সেই সময় ফিল্ম সোসাইটির প্রধান বিষয় ছিল হাসির ও শিশুতোষ বিষয়ক বিভিন্ন সিনেমা দেখানো। স্কুলে চার্লি চ্যাপলিনসহ অন্যান্য কমেডি অভিনেতাদের মুভিগুলো দেখতেন এবং নিজের অজান্তেই তাদের নকল করা শুরু করেন। এক সময় মঞ্চের পেছনে কাজ করা শুরু করেন। এরপর পেছন থেকে চলে আসেন মূল মঞ্চে। মঞ্চে রোয়ান অ্যাটকিনসনের অভিনয় দেখে তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভিনয়কে সিরিয়াসভাবে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে রোয়ান অ্যাটকিনসন ছিলেন সিরিয়াস, তাই পড়াশোনাটাকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে অভিনয় করা কিংবা কমেডিয়ান হওয়া কোনটিই মি. বিনের লক্ষ্য ছিল না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে রিচার্ড কার্টিসের সঙ্গে পরিচয় হয় মি. বিনের। রিচার্ড কার্টিস ছিলেন একজন নাট্যকার ও গীতিনাট্য অভিনেতা। রিচার্ড কার্টিস ও রোয়ান অ্যাটকিনসন মিলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘অক্সফোর্ড নাট্যশালা’। রিচার্ড কার্টিসের সঙ্গে নাটক লেখাও শুরু করেন। সেইসঙ্গে কমেডি নাটকে অভিনয়। এছাড়া তারা একসঙ্গে বিবিসি রেডিও থ্রিতে ‘দ্য অ্যাটকিনসন পিপল’ নামের একটি স্যাটারিক্যাল ইন্টারভিউধর্মী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন।

যেভাবে মি. বিন
bean

মুভি ও টিভি অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জনপ্রিয় হলেও শুরুর দিকে তিনি কমেডি বই লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭৯ সালে তার লেখা স্কেচ কমেডি শো ‘নট দ্য নাইট ও’ক্লোক নিউজ’ নামের বইয়ের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে বেশ ভালোভাবে জায়গা করে নেন। বইটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, বেস্ট সেলিং ও ব্রিটিশ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ও আন্তর্জাতিক অ্যামি অ্যাওয়ার্ডও জয় করে নেয়। পরবর্তীতে এই বই থেকে টিভি কমিক অনুষ্ঠান তৈরি করা হয় এবং তাতে অভিনয় করেন স্বয়ং রোয়ান অ্যাটকিনসন। নব্বই দশকের প্রথম দিকে মি. বিন সিরিজ টিভিতে শুরু হয়। মি. বিনের প্রথম পর্ব প্রচারিত হয় ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি। মি. বিনের নাম প্রথমে ছিল মিস্টার হোয়াইট। পরে তার নাম হয় মি. বিন। এরপর থেকে টানা বিশ বছর এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রথমে শুধু টিভি সিরিয়াল থাকলেও মি. বিন নিয়ে সিনেমা, এমনকী কার্টুনও নির্মিত হয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রোয়ান অ্যাটকিনসন ২০১১ সালে বিবিসির এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি যখন ছাত্র তখন থেকেই মি. বিনের মতো একটি চরিত্রের ধারণা তার মাথায় গড়ে উঠেছিল।

মি. বিন থেকে বিদায়
bean
দ্রুতগতির গাড়ি রোয়ানের খুবই পছন্দের। তাই ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ফর্মুলা ওয়ান স্পোর্টস কার বেছে নিয়েছেন তিনি। এ ধরনের স্পোর্টস কার পৃথিবীতে রয়েছে মাত্র ১০০টি। ২০১১ সালের ৫ আগস্ট তিনি ওই গাড়িতেই অ্যাক্সিডেন্ট করেন এবং তার কাঁধে অপারেশন করতে হয়। এর কিছুদিন পর ২০১২ সালের নভেম্বরে ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মি. বিন চরিত্রে আর হাজির না হওয়ার ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এই চরিত্রটি দিনেদিনে তাকে শিশুতে রূপান্তর করে দিচ্ছে।

তিনি আরো জানান, মি. বিন চরিত্রের জন্য নিজেকে আর উপযোগী মনে করছেন না। কারণ মি. বিন চরিত্রের জন্য আরও তরুণ কাউকে প্রয়োজন। এছাড়া তিনি মি. বিন’স হলিডে করার পরও বলেছিলেন, তিনি আর নতুন কোনো ছবিতে অভিনয় করবেন না। তবে দর্শকদের অনুরোধে তিনি সেই বছরই জনি ইংলিশের সিক্যুয়াল ‘জনি ইংলিশ রিটার্ন’র মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

পুরস্কার
bean

রোয়ান অ্যাটকিনসনের জয়ের তালিকায় আছে ব্রিটিশ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ও বিবিসি বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের পুরস্কার। তিনি মি. বিন সিরিজে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৮০ সালের সেরা কমেডিয়ান হিসেবে নির্বাচিত হন। এছাড়াও বিএএফটিএসহ নানা পুরস্কার জিতেছেন।

নির্বাক ছবির এই সবাক অভিনেতা বেঁচে থাকুক হাজার বছর। তার করা অভিনয়ে বাঁচিয়ে রাখুক হাজার প্রাণের হাসি। উইকিপিডিয়া

এসইউ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।