লোকবল সংকটে ব্যাহত কিডনি প্রতিস্থাপন

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ পিএম, ০৯ মার্চ ২০২৩
ফাইল ছবি

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৮ বছর বয়সী রাবেয়া। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা রাবেয়ার সম্প্রতি কিডনিজনিত রোগ ধরা পড়েছে।

রাবেয়ার নিকটাত্মীয় আবদুস সালাম বলে, প্রথমে রাবেয়ার কোমরের নিচে বড় দাগ দেখা দেয়। এসময় ব্যথাসহ নানা যন্ত্রণায় ভোগেন তিনি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে টেস্ট করে চিকিৎসক জানান তার কিডনিতে সমস্যা। একটা কিডনি সাদা ও ছোট। এই সমস্যা নিয়ে ঘুরেছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। জেলা সদরে কিডনি রোগের ভালো চিকিৎসা পাবেন না ধারণা করে সেখানে যাননি তিনি।

আরও পড়ুন: যে কারণে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে 

দীর্ঘ ৬ মাস ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন মাদারীপুরের শীবচর উপজেলার মৌসুমি আক্তার। একদিন হঠাৎ করে পেটে ব্যথা ও বমি শুরু হয় মৌসুমির। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরও ব্যথা না কমায় নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসকের কাছে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায় তার কিডনিতে পাথর। তবে সিটিস্ক্যান দেখে চিকিৎসকের ধারণা তার কিডনিতে অন্য সমস্যাও থাকতে পারে। বর্তমানে তার ডায়ালাইসিস চলছে। অপারেশন করার কথা থাকলেও ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ থাকায় অপারেশন করা যাচ্ছে না।

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে আসেন মিরপুরের বাসিন্দা আবু বক্কর ছিদ্দিক। চার বছরে ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন তিনি। সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস ও একটি ইনজেকশনে তার খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। সঙ্গে ওষুধ ও যাতায়াত বাবদ খরচ আরও পাঁচ হাজার টাকা। তিনি জানান, খরচ চালাতে গিয়ে তিনি ও তার পরিবার পথে বসার উপক্রম। কিছুদিন পর ডায়ালাইসিস চালাতে পারবেন কি না সে বিষয়ে শঙ্কার কথা জানান তিনি।

বাড়ছে কিডিনি রোগীর সংখ্যা
২০১২ সালে থেকে ২০২২ সালে অর্থাৎ গত এক দশকে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনে আসা কিডনি রোগী বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০১২ সালে এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৭৫ জন। ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৬৭১ জন। এ সময়ে বেড়েছে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগীর সংখ্যাও। ২০১২ সালে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগী ছিল ২২ হাজার। ২০২২ সালে এসে হয়েছে ৬৭ হাজার ৬২০ জন।

আরও পড়ুন: কিডনি রোগের যে লক্ষণ ফুটে ওঠে ত্বকে 

অন্যদিকে, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য বলছে, গত বছরে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন এক লাখ ৬৩ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে ৯৭ হাজার ৮৫৭ জন নতুন রোগী। পুরাতন রোগী ৬৫ হাজার ২৩৮ জন। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী নতুন। এর আগের বছর (২০২১ সালে) চিকিৎসা নিয়েছিলেন এক লাখ ২৪ হাজার ১২২ জন। তার আগের বছর ২০২০ সালে চিকিৎসা নেন ৯৭ হাজার ৮৮৪ জন। এই হাসপাতালে বেড়েছে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগীর সংখ্যাও। ২০১৭-২০১৮ সালে এখানে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগী ছিল দেড় হাজারের কম। ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ১৩ হাজার ৭৪৮ জনে।

এদিকে, দিনে দিনে রোগী বাড়লেও দেশের হাসপাতালগুলোতে লোকবল সংকটে ঠিকমতো হচ্ছে না কিডনি প্রতিস্থাপন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত মোট দুই হাজারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। ১০ বছর আগে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো বছরে একশটিরও কম। বর্তমানে বছরে কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে ২১০টির মতো।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালনা করা হলো বিশ্ব কিডনি দিবস। প্রতি বছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এই দিবস পালন করা হয়। বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য- ‘সবার জন্য সুস্থ কিডনি’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কিডনি বিশেষজ্ঞরা জানান, ৮০ শতাংশ বিকল হওয়া পর্যন্ত কিডনি রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। এতে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন শেষ সময়ে। যখন তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে চিকিৎসার বাইরে থাকছেন ৮০ শতাংশ রোগী। তাদের মধ্যে প্রতিবছর মৃত্যু হচ্ছে ১০ হাজারের বেশি।

কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯০০ জন রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলেন। তবে, ৮০ শতাংশের বেশি কিডনি রোগী আর্থিক সংকটে ডায়ালাইসিস সেবা নিতে পারছেন না। ফলে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তারা।

আরও পড়ুন: শুরুতে শনাক্ত করলে ৫০ ভাগ কিডনি রোগ ঠেকানো সম্ভব 

তিনি বলেন, দেশে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের কারণ বিশ্লেষণ করে যতটুকু বোঝা যায়, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের জন্য কিডনি প্রদাহ ৪০ শতাংশ, ডায়াবেটিস ৩৪ শতাংশ, উচ্চ রক্তচাপ ১৫ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ১১ শতাংশ দায়ী। এছাড়া আকস্মিক কিডনি রোগের কারণ ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, আকস্মিক রক্তক্ষরণ, ইনফেকশন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও আকস্মিক হৃদরোগ।

অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রতি ৬০০ রোগীর জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে যে ননডক্টর (চিকিৎসক নন তবে প্রশিক্ষিত) থাকেন তাদেরকে যদি শুধু এলভোস্টিক সাপ্লাই করে দেই, যেটি দিয়ে এলবুমিন দেখা যায়, গ্লুকোজ দেখা যায়, ব্লাড যাচ্ছে কি না দেখা যায়। এ তিনটা (পরীক্ষায়) খরচ মাত্র ১৫ টাকা। এটা টেস্ট করেই জানা যাবে কিডনির সমস্যা আছে কি না। আমাদের যাদের ৪০ বছরের বেশি বয়সী, তারা যেন প্রাথমিকভাবে ইউরিন টেস্ট, রক্তচাপ পরীক্ষা, ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে নেই। এতে যেকোনো একটা পজিটিভ হলে তখন তিনি চিকিৎসকের কাছে যাবেন। এভাবে যদি করা হয় তবে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে একজন ক্রনিক কিডস বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছেন। তবে বয়স্কদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। যাদের বয়স ৬৫ থেকে ৭৫ বছর তাদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে একজন পুরুষ ও প্রতি ৪ জনে একজন নারী কিডনি রোগে ভুগছেন। আর যাদের বয়স ৭৫ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন প্রোগ্রাম রান করার জন্য ডেডিকেটেক ইউনিট থাকা দরকার। আমরা এখনো পর্যন্ত কেন এটি তৈরি করতে পারিনি? এছাড়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারির ক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে না। দেখা যায়, আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যখনই একটা প্রশিক্ষিত টিম তৈরি হলো, তখন দেখা যায় কিছুদিন যেতে না যেতেই অনেকে বদলি হয়ে যান। তখন আর টিমটা কাজ করতে পারে না।

তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত। দেখা যায়, অনেক সময় ডোনার আছে কিন্তু ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী ওষুধের ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য অনেক রোগীর থাকে না। তবে যারা উচ্চবিত্ত তারা সরকারি হাসপাতালে আগ্রহী নন। তারা (চিকিৎসার জন্য) চলে যান দেশের বাইরে। পাশাপাশি কিডনি দাতার সংকটও রয়েছে।

এএএম/কেএসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।