‘অনেক কষ্টে আল্লায় ছেলেরে দিসে, না বাঁচলে কিছুই থাকবে না’

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩
নেওয়াজের দুরন্তপনার ছবি দেখাচ্ছেন মা, সেই ছেলে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে

ক্যানসার হাসপাতালের ছয়তলার পুরুষ ওয়ার্ডের ২৪ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে নেওয়াজ। কুমিল্লায় বাড়ি তাদের। মাত্র সাত বছর বয়সেই ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে তার। একমাত্র সন্তানের এই দুরারোগ্য ব্যাধি জীবনের সব সুখই কেড়ে নিয়েছে মা পারভীন আক্তারের।

রোববার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দেখা মেলে তাদের। এসময় দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে নেওয়াজ। আর পাশে বসে মা তার পায়ে মালিশ করে চলেছেন। অপরদিকে চলছে স্যালাইন। মা একটু মালিশ বন্ধ করলেই কেঁদে উঠছে নেওয়াজ।

এসময় শিশুটির মা পারভীন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে দুরন্ত ছিল। অনেক দুষ্টুমি করতো। পড়াশোনায় ছিল ভালো। এবছর পরীক্ষা দিয়ে নার্সারিতে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তার আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ করেই তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। জ্বর আসে। অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুতই কুমিল্লায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে পরীক্ষায় ধরা পড়ে ব্লাড ক্যানসার। তবে আমার সুস্থ ছেলের এ ধরনের কিছু হবে তা আমি বিশ্বাস করতে পারেনি। তাই আশপাশে আরও কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করি। টেস্টের রেজাল্ট দেখে কেউ তাকে রাখতে চায়নি।

আরও পড়ুন: শরীরে ক্যানসার আছে কি না বুঝে নিন লক্ষণ দেখেই

পারভীন আক্তার বলেন, এরপর নেওয়াজকে আমরা ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসি। সেখানে অনেক মানুষ আর দীর্ঘ লাইন। পরীক্ষা করাতে সময় লেগে যায় অনেক। তারপরও সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা করাই। এসময় দালালরা ছেলেকে বেসরকারি হাসপাতালে নিতে বলেছিল। তাদের কথা না শুনে নেওয়াজকে নিয়ে যাই ক্যানসার হাসপাতালে। এখানে এসেও ডাক্তার ও টেস্টের জন্য ঘুরতে হয়েছে অনেকদিন। টেস্ট করতে আর রেজাল্ট পেতে লেগে যায় দুই থেকে তিনদিন। আবার সেই রেজাল্ট নিয়ে গেলে রোগীর শরীরের চারদিন আগের কন্ডিশনের টেস্ট হবে না বলে আবার পরীক্ষা করতে বলেন ডাক্তার। এছাড়া দেখা যায়, দুপুর ১২টার পর ফাইল জমা নেয় না। এভাবে কয়েক দফা পর প্রায় ১৫-১৬ দিন পর হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারি ছেলেকে। এরপর নয়দিন ধরে এখানেই আছি।

তিনি নেওয়াজের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানান, ছেলের কোমরের পেছনে ফুলে গেছে। সারারাত ঘুমায় না। সবসময় তার পা মালিশ করা লাগে। পায়ে অনেক ব্যথা। একটু পর পরই কান্না করে ওঠে সে।

আরও পড়ুন: মলত্যাগের সময় বসার যে ভুলে হতে পারে অন্ত্রের ক্যানসার

এসময় কান্না জড়িত কণ্ঠে পারভীন আক্তার বলেন, আমার এই ছেলে ছাড়া আর কিছুই নেই। অনেক কষ্ট করে দীর্ঘদিন পর সন্তানকে আল্লাহ দিয়েছে। নতুন করে আর বাচ্চা হবে না। ও বাঁচলে আমি আছি নইলে শেষ।

‘অনেক কষ্টে আল্লায় ছেলেরে দিসে, না বাঁচলে কিছুই থাকবে না’

এসময় তিনি নেওয়াজের মাদরাসায় যাওয়ার ছবি ও পারিবারিক ছবি দেখান। যেখানে দেখা যায় এক প্রাণবন্ত নেওয়াজকে।

পারভীন আক্তার জানান, তার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। অল্প কিছু টাকা আয় হয়। তা দিয়ে সংসার চলে। ছেলের কুমিল্লায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেই প্রায় ৯৫ হাজার টাকা চলে যায়। এরপর ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে যায় আরও অনেক টাকা।

এসময় নেওয়াজের মা হতাশার সুরে বলেন, ভবিষ্যতের কথা তো জানি না। মাত্র তো শুরু। ওকে সুস্থ রাখতে যা খরচ করতে হয় তা তো করবো। কিন্তু কীভাবে এসব ম্যানেজ করবো তা জানি না। আল্লাহ ওর ওপর রহম করুক।

পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কথায়ও জানা যায় নেওয়াজের দুরন্তপনার কথা। সবার সঙ্গে হেসেখেলেই চলছিল তার জীবন। হঠাৎ নেওয়াজের এ অবস্থা কেউ মেনে নিতে পারছে না।

‘অনেক কষ্টে আল্লায় ছেলেরে দিসে, না বাঁচলে কিছুই থাকবে না’

আরও পড়ুন: ধূমপান না করলেও হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসার, জানুন লক্ষণ

নেওয়াজের মতো আরও অনেকে ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। সেখানে দেখা যায় ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের কষ্ট। তাদের পরিবারের করুণ চেহারা। রোগীদের মাঝে সুস্থতার আকাঙ্ক্ষা, আর স্বজনদের মাঝে তাদের প্রিয় মানুষকে সুস্থ করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তবে এ ক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন খুব কমই মানুষ।

ক্যানসার হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসক কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি রোগী। এজন্য রোগীদের একটু অপেক্ষা করতেই হয়। হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসকই সামাল দিচ্ছেন রোগীদের।

ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ হওয়ার হার কেমন জনতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবো না। তবে রোগীরা যদি আক্রান্তের প্রথম স্টেজে আসেন সেক্ষেত্রে ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব। তবে আমাদের এখানে বেশিরভাগ ঢাকার বাইরে ও গরিব রোগীরা আসেন। দেখা যায়, প্রথম দিকে তারা কবিরাজি ও হাকিমি ওষুধ খেয়ে অবস্থার আরও খারাপ করে আসেন। তারা আসেন তৃতীয় -চতুর্থ স্টেজে। এক্ষেত্রে তাদের বাঁচানো কষ্ট হয়ে পড়ে।

এএএম/জেডএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।