শীতে কাবু শিশুরা, হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগীর চাপ

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩৩ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪

অডিও শুনুন

সারাদেশে বেড়েছে শীতের প্রকোপ। চলছে শৈত্যপ্রবাহ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শীতজনিত নানান রোগব্যাধি। এসবের মধ্যে অন্যতম জ্বর, ঠান্ডা, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও চর্মরোগ। শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেও ছাড় পাচ্ছেন না অন্য বিভিন্ন বয়সের মানুষেরাও।

সরেজমিনে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা গেছে, ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় অনেক শিশুকে চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন অভিভাবকরা। সকাল থেকেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগের সামনে দীর্ঘ লাইন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গরম কাপড়ে মোড়ানো শিশুদের কোলে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন অভিভাবকরা। তাদের মুখে চিন্তার ভাঁজ।

এক মাস ধরে তিন মাস বয়সী শিশুসন্তান ওমর ফারুককে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটছেন তার মা মিলি। কোলের শিশুর চিন্তায় অস্থির মিলি পাচ্ছেন না কূল-কিনারা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এক মাসে তিনটি হাসপাতাল পরিবর্তন করেছি। ১৪ দিন ধরে শিশু হাসপাতালে আছি। এখনো সন্তানের সুস্থ হওয়ার লক্ষণ দেখছি না।

আরও পড়ুন: শীতে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ঝুঁকিতে শিশু-বয়স্করা

তিনি আরও জানান, হঠাৎ ঠান্ডা অস্বাভাবিক বাড়ায় শিশু ওমরের গলায় কফ জমেছে। এরপর থেকে সে কিছুই খেতে পারছে না। এক মাসে সন্তানের চিকিৎসায় প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো সুস্থ হয়নি ওমর।

এ ধরনের রোগীদের কোনো সংক্রমণ নেই, জ্বরও নেই। কিন্তু নাক বন্ধ থাকায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নবজাতক হলে দুধ টেনে পান করতে পারে না। বাচ্চা ঘুমাতে পারে না, কান্নাকাটি করে। শীতের সময় বাচ্চারা শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এসময় বাচ্চাদের অ্যাজমাও বেড়ে যাচ্ছে। ধূলিকণা নিশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে ছোট-বড় সবারই ক্রনিক কাশি হচ্ছে

বরিশাল থেকে ১৫ মাস বয়সী শিশুসন্তান হাফসাকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে এসেছেন মা এমি আক্তার। শীতের শুরু থেকেই হাফসার শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও কাশি ছিল। এমি আক্তার সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন প্রায় ২৫ দিন ধরে।

তিনি জাগো নিউজকে জানান, এখন শ্বাসকষ্ট ও জ্বর-কাশি একটু কমেছে। তবে নতুন করে ডাক্তাররা জানিয়েছেন তার (হাফসার) হার্টে ছিদ্র আছে। এখন কী করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। সন্তানকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।

শীতকালীন অসুস্থতা হিসেবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়া বড় আকারে দেখা দিয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব রোগে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩১৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬১ হাজার ৯২৪ জনের তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং এক লাখ ৭১ হাজার ৩৯৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন

শীতকালীন ডায়রিয়া নিয়ে অনেক রোগী শিশু হাসপাতালে গেলেও প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে তাদের বাসায় ফেরত পাঠানো হয়। বলা হয়, বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে। তবে হাসপাতাল ঘুরে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি থাকা চারজন রোগীর দেখা মিলেছে।

ময়মনসিংহ থেকে শিশু তাকরিমকে নিয়ে এসে শিশু হাসপাতালের ২৫ নম্বর বেডে ভর্তি করিয়েছেন তার মা অন্তরা। চারদিন ধরে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন তিনি।

আরও পড়ুন: শীতে শিশুর কোন রোগের ঝুঁকি বাড়ে?

অন্তরা জাগো নিউজকে বলেন, ডায়রিয়ায় সন্তানের তিন কেজি ওজন কমে গেছে। হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। কোনোভাবেই কমছিল না। পরে এলাকা থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছি। এখন আগের তুলনায় ভালো।

দেখা যায় মা-বাবা শিশুকে অতিরিক্ত কেয়ার করতে গিয়ে বেশি উষ্ণতা দিয়ে ফেলছেন। এতে শিশুর শরীর থেকে যে ঘাম বের হয় সেটি তার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। এছাড়া সারাদিন দরজা-জানাল বন্ধ রাখা যাবে না। ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে দিতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। এছাড়া শিশুর সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে

হাসপাতালটির জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগেও ঠান্ডাজনিত রোগীর ভিড় চোখে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীত মৌসুম এলে অন্য রোগী কিছুটা কমলেও ঠান্ডাজনিত রোগীদের চাপ বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও চর্মরোগে আক্রান্তের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঠান্ডাজনিত রোগে গত এক মাসে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় ৩২ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সারাদেশে রোগীদের তথ্যের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শীতকালীন অসুস্থতা হিসেবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়া বড় আকারে দেখা দিয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব রোগে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩১৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬১ হাজার ৯২৪ জনের তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং এক লাখ ৭১ হাজার ৩৯৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই ঠান্ডাজনিত মৌসুমি রোগব্যাধি বাড়ে। আমাদের হাসপাতালেও এ ধরনের রোগী আসছে। তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা থাকায় রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুন: তীব্র শীতে বন্ধ থাকবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ও

তিনি জানান, গত নভেম্বরে ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে ৩৮৮ জন, ডিসেম্বরে ৪২৫ এবং চলতি জানুয়ারি মাসের ১২ দিনে ১৭০ জন শিশু এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে আসা রোগীর অভিভাবকরা বেশিরভাগই নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, শাসকষ্টের কথা বলছেন। চিকিৎসকরা শারীরিক অবস্থা দেখে ভর্তি করছেন। বাকিদের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ায় পিআইসিইউতে (পেডিয়েট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) রাখা হচ্ছে।

প্রয়োজনের বেশি উষ্ণতায় শিশুকে রাখা যাবে না জানিয়ে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা শিশুকে অতিরিক্ত কেয়ার করতে গিয়ে বেশি উষ্ণতা দিয়ে ফেলছেন। এতে শিশুর শরীর থেকে যে ঘাম বের হয় সেটি তার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। এছাড়া সারাদিন দরজা-জানাল বন্ধ রাখা যাবে না। ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে দিতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। এছাড়া শিশুর সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।

এসময়ে স্কুল কিংবা মাদরাসা পড়ুয়া খুদে শিক্ষার্থীদের গায়ে বিভিন্ন ধরনের চুলকানি দেখা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো ছোঁয়াচে হয়। শিশুরা একজন অন্যজনের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করে। তাই গায়ে চুলকানি দেখা দিলে শিশুকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখতে হবে।

শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, শীতের সময় শিশুদের রোগবালাই বেশি দেখা দেয়। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুকে সুস্থ রাখতে বেশিরভাগ সময় মাথা ঢেকে রাখতে হবে। অহেতুক বাসার বাইরে বা মার্কেটে শিশুকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে কিনে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা জাগো নিউজকে বলেন, শীত মৌসুমে শুধু হাসপাতালে নয়, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও শীতজনিত রোগীর অনেক চাপ। শীত ও বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা বছরের অন্য সময়গুলোর চেয়ে এখন দু-তিন গুণ বেড়ে গেছে। শিশুদের অনেকে আসছে সর্দি, নাক বন্ধ হওয়া ও হাঁচি-কাশি নিয়ে। একটা অংশের তীব্র জ্বর, গলা ব্যথা ও কাশি।

আরও পড়ুন: যে কারণে তীব্র শীত, থাকবে আরও যে কদিন

তিনি বলেন, দেখা গেছে, এ ধরনের রোগীদের কোনো সংক্রমণ নেই, জ্বরও নেই। কিন্তু নাক বন্ধ থাকায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নবজাতক হলে দুধ টেনে পান করতে পারে না। বাচ্চা ঘুমাতে পারে না, কান্নাকাটি করে। শীতের সময়ে বাচ্চারা শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এসময় বাচ্চাদের অ্যাজমাও বেড়ে যাচ্ছে। ধূলিকণা নিশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে ছোট-বড় সবারই ক্রনিক কাশি হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের সময় এসব সমস্যা বেশি হয়।

এএএম/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।