চোরাইপথে এনে ‘মেড ইন জার্মানি’ লিখে ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৩১ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

দেশে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছেই। আক্রান্ত রোগীদের জন্য সবচেয়ে জরুরি নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা পরীক্ষা করানো। ভোগান্তি এড়াতে অনেকে বিভিন্ন কোম্পানির ‘কুইক স্ট্রিপ’ কিনে ঘরে বসেই ডায়াবেটিসের মাত্রা পরীক্ষা করেন। এর ওপর ভরসা করেই চিকিৎসা, খাদ্যগ্রহণসহ দৈনন্দিন জীবনযাপন করেন।

যে স্ট্রিপগুলো বাজারে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার মধ্যে অন্যতম ‘আকু-চেক অ্যাকটিভ স্ট্রিপ’। অথচ এ স্ট্রিপটি চোরাইপথে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। এরপর রাজধানীর নয়াপল্টন, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার প্রেস থেকে ব্যাচ নম্বর, বার কোডসহ মোড়ক তৈরি করে সেগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি অভিযান চালায়। তাতে উঠে এসেছে এমন তথ্য। এরপরই ডায়াবেটিস মাপার স্ট্রিপ বিপণনকারী, ফার্মেসি মালিকসহ বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে মতবিনিময় সভা ডাকে ভোক্তা অধিদপ্তর।

রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবি ভবনে অধিদপ্তরের কার্যালয়ে এ মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়।

মতবিনিময় সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচলক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ডায়াবেটিস মাপার নকল স্ট্রিপ বাজারজাত করার কারসাজির ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিসের নকল স্ট্রিপ বিক্রি নিয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমাদের একটি টিম তদন্ত শুরু করে। তাতে দেখা যায় যে, ফার্মা সলিউশন নামের ওষুধ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান এ স্ট্রিপ আমদানি করে বিক্রি করছে। আকু চেক অ্যাকটিভ নামের স্ট্রিপের মোড়কে মেইড ইন জার্মানি লেখা। এটার উৎপাদক নাকি জার্মানির প্রতিষ্ঠান রোস।’

সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ হলো। আমরা লাজ-ফার্মা থেকে কিছু স্যাম্পল কালেকশন করলাম। লাজ-ফার্মাকে অফিসে ডাকলাম। তাদের থেকে জানতে পারলাম এটার আমদানিকারক ফার্মা সলিউশন। ঢাকায় ফার্মা সলিউশনের ৪-৫টা ডিপো রয়েছে। তেজকুনিপাড়ার ডিপোতে আমরা অভিযান চালালাম। কিন্তু তারা এগুলো নিয়ে কিছুই বলবে না।’

আকু চেক স্ট্রিপ নিয়ে জার্মানির রোস কোম্পানির সঙ্গেও ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন বলে জানান ডিজি সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তদন্ত চালানোর সময় আমরা জার্মান কোম্পানি রোসের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করি। তারা আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে, তারা এ ব্যাচধারী কোনো স্ট্রিপ উৎপাদনই করেন না। তাহলে বাংলাদেশের বাজারে এগুলো কোথা থেকে এলো? গায়েবিভাবে এলো কি না?’

ভোক্তার ডিজি বলেন, ‘সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে যেটা বেরিয়ে এলো, তা হলো এগুলো তারা লাগেজ পার্টির মাধ্যমে দেশে এনেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ (ভারত) থেকে নকল এসব স্ট্রিপ কাপড়ের লাগেজের মধ্যে করে আসে। তারা শুধু স্ট্রিপ কৌটায় করে নিয়ে আসে। পরে নয়াপল্টনের প্রিন্ট ওয়ান নামের প্রেসে সব কারসাজি করা হয়। হাতিরপুলের প্রেসেও এ কাজ করে তারা। মনগড়া ব্যাচ নম্বর বসিয়ে দেওয়া হয়, বার কোডও দেওয়া হয়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা নকল।’

jagonews24

ফার্মাসি সেক্টরের কারসাজি চরম হতাশাজনক উল্লেখ করে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আপনি জাল টাকা উৎপাদন করে যতটা না ক্ষতি করতে পারবেন, তার চেয়ে নকল ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরিতে বেশি ক্ষতি হবে। দেশের ৭-৮ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অথচ আপনি এর নকল চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর চেয়ে খারাপ কাজ আর কিছু হতে পারে না।’

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ফার্মা সলিউশনের প্রধান নির্বাহী পল্লব চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকার করছি এটা ঘটেছে। এটা খারাপ কাজ হয়েছে। কোম্পানির কিছু বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে এটি হয়েছে। বিক্রয়কর্মীদের নানা ধরনের চাপ থাকেন, চাপে পড়ে তারা এটা করেছেন। তবে দায় আমাদেরও নিতে হবে। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়।’

মোড়ক তৈরি করা প্রতিষ্ঠান প্রিন্ট ওয়ানের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ফার্মা সলিউশনকে আমরা বিশ্বাস করে কাজ নিয়েছিলাম। তাদের লেনদেন প্রক্রিয়াও ভালো। আমরা বিশ্বাস করে তাদের কাজ নিয়েছি। দুই ধাপে ১০-১২ হাজার টাকার প্রিন্টিংয়ের বিল পেয়েছি। এরপরও আমাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। আমিও দায় এড়াবো না। যে কাজের সঙ্গে না জেনে আমরা জড়িয়েছি সেটাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। আমরা ভবিষ্যতে সাবধানে কাজ করবো।’

মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআই’র পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী। নকল স্ট্রিপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির, ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক প্রমুখ।

এদিকে, মতবিনিময় সভায় যোগ দেওয়া ফার্মেসি প্রতিনিধিরা বাজারে থাকা ফার্মা সলিউশনের সব স্ট্রিপ তুলে নিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানান। তারা অনুমোদনবিহীন এ স্ট্রিপ বিক্রি করতেও চান না।

ফার্মেসি প্রতিনিধিদের এমন বক্তব্যের পর ফার্মা সলিউশন বাজারে কী পরিমাণ আকু-চেক অ্যাকটিভ স্ট্রিপ বাজারে ছেড়েছে, সেই তথ্য চেয়েছে। শিগগির তথ্য দেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে সংস্থাটি।

এএএইচ/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।