সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান তামাক। আপাতদৃষ্টিতে তামাক একটি ভেষজ উদ্ভিদ হলেও এটি নেশাদায়ক উদ্ভিদ। কারণ এতে আছে ক্ষতিকর নিকোটিন নামক স্নায়ুবিষ। তামাক বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন- সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকো, গাঁজা (তামাকের সাথে মিশিয়ে)। অন্যান্য ধূমপানের মাধ্যমেও তামাক গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া অনেকেই পানের সঙ্গে শুকনো তামাক পাতা খান (জর্দা হিসেবে)।
তামাক স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং অন্য মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর ৩১ মে পালিত হয় ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৭ সালে দিবসটি চালু করে। যার মূল উদ্দেশ্য—তামাক ব্যবহারজনিত ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালার প্রচার। দিবসটি শুধু পরিসংখ্যান আর স্লোগান নয়। দিবসটি পালনের উপলব্ধি অনেক। কারণ এই তামাক ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।
নীরব ঘাতকতামাক বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটায়। যার মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায় প্যাসিভ স্মোকিং বা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে। এটি এখনো পৃথিবীর অন্যতম প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর কারণ। ধূমপান হোক কিংবা চিবানো তামাক, উভয়ই ক্যানসার, হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত সমস্যা ও গর্ভকালীন জটিলতার কারণ হতে পারে। তামাক শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না—এটি প্রভাব ফেলে পরিবার, অর্থনীতি এবং পরিবেশেও। চিকিৎসা ব্যয় গরিব পরিবারগুলোর জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। এ ছাড়া অনেক ছেলেমেয়ে বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনায় পড়ে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। এভাবে নিজেদের অজান্তে পরিবেশে তামাকজাত পণ্যের ধোয়া ছড়িয়ে দেয়। অনেক অধূমপায়ী মানুষেরও ক্ষতি করে। তামাক কোম্পানিগুলো প্রায়ই তরুণ, দরিদ্র ও নারীদের লক্ষ্য করে ধূর্তভাবে পণ্যের প্রচার করে। যা এখন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
Advertisement
এবারের প্রতিপাদ্য: তরুণদের রক্ষাপ্রতি বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর কেন্দ্রে রয়েছে তরুণদের রক্ষা, বিশেষত ই-সিগারেট ও ফ্লেভারযুক্ত তামাকজাত পণ্য থেকে। এসব আধুনিক পণ্য ‘নিরাপদ’ বলে প্রচার করা হয়। গবেষণা বলছে, এগুলোর আসক্তি এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি অত্যন্ত গুরুতর। তাই এবারের প্রতিপাদ্য হলো—‘উজ্জ্বল পণ্য, অন্ধকার উদ্দেশ্য: আকর্ষণের মুখোশ উন্মোচন’। এতে বোঝানো হয়েছে ক্ষতিকারক নিকোটিন পণ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া।
আরও পড়ুন একক পরিবার বনাম একান্নবর্তী পরিবার সেবা-শুশ্রূষার নেপথ্যে যারাবাংলাদেশ: এক সন্ধিক্ষণেবাংলাদেশে তামাক ব্যবহার এখনো বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩৫% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকের কোনো না কোনো রূপ ব্যবহার করে। যদিও পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং বিজ্ঞাপনে কিছু নিয়ম আছে, বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ এখনো দুর্বল। বাংলাদেশ অ্যান্টি-টোব্যাকো অ্যালায়েন্স ও প্রজ্ঞাসহ বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। তবে চ্যালেঞ্জ অনেক। শহরের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গ্রামের হাটবাজার—তামাক যেন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা ও সচেতনতার ভূমিকাবিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস মনে করিয়ে দেয়, সচেতনতা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। ক্যাম্পেইন, স্কুল প্রোগ্রাম, সেমিনার ও কমিউনিটি কর্মসূচি—এসবই তামাকবিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। উদ্দেশ্য শুধু বর্তমান ব্যবহারকারীদের থামানো নয় বরং নতুন প্রজন্মকে আসক্তি থেকে দূরে রাখা। আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষের গল্প, পারিবারিক সমর্থন ও সরকারি সহায়তা—এসব কার্যক্রম একটি আশার আলো দেখাতে পারে। ছাড়তে পারা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
নাগরিক হিসেবে করণীয়আপনি যদি তামাক ব্যবহার করেন, আজই হোক একটি নতুন শুরু। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, সহযোগিতা খুঁজুন, নিজের এবং পরিবারের জন্য এগিয়ে আসুন। আপনি যদি ব্যবহার না করেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখুন। বন্ধুদের জানান, নীতিনির্ধারকদের সমর্থন করুন ও ভুল প্রচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। পরিবেশবাদী হিসেবে তামাকশিল্পের পরিবেশগত ক্ষতি জানুন এবং টেকসই বিকল্পের পক্ষে অবস্থান নিন।
Advertisement
কেবল বার্তা নয়, অনুপ্রেরণাবিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস শুধু বার্তা দেওয়ার দিন নয় বরং এটি একটি জাগরণ। একসাথে স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর প্রতিশ্রুতি। সচেতনতা, প্রতিরোধ আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারি। চলুন, আমরা ধোঁয়ার নয়, শুদ্ধতার বাতাসের সাথী হই। আসক্তির ছাইয়ের পরিবর্তে পরিবর্তনের আলো বেছে নিই।
এসইউ/এএসএম