জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন। এর পর থেকে মামলা থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরাও আছেন উদ্বেগে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত এমন শিক্ষক আছেন ১৪ জন। এর মধ্যে পাঁচজন আপস করে মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা কয়েকটি মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আসামি করা হয়েছে। গত ২৮ মে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আনোয়ারা বেগম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্যও ছিলেন। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় দায়ের করা দুটি মামলার একটি দায়ের করেন ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য অনিক কুমার দাস। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনিক কুমার দাসের পেটে গুলি লাগে।
আন্দোলনের সময় আমার ওপর গুলি চালানো হয়। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। এছাড়া ফ্যাসিবাদী শক্তি এটার মদত দেয়। আমি বিচারের জন্য মামলা করি। কিন্তু পরবর্তীসময়ে পাঁচ শিক্ষককে আপসনামা করে মামলা থেকে অব্যাহতি দিই।- মামলার বাদী অনিক কুমার দাস
Advertisement
ওই ঘটনায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তিনি গত ২২ নভেম্বর মামলা করেন। মামলার আসামি শিক্ষকরা হলেন- অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়া মিয়া, ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মাসফিক হাসান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল, সাবেক সহকারী প্রক্টর নিউটন হাওলাদার, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কামরুন নাহার লিপি ও ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক শাসুল কবির।
পরবর্তীসময়ে পাঁচজন শিক্ষকের সঙ্গে আপসনামা করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন অনিক। ওই শিক্ষকরা হলেন- অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়া মিয়া, অধ্যাপক ড. শেখ মাশরিক হাসান, অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক শামসুল কবির।
সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার নামে মামলা করেন অনিক কুমার দাস। পরবর্তীসময়ে অঙ্গীকারনামার মাধ্যমে স্বীকার করেন যে, ঘটনার দিন আমি উপস্থিত ছিলাম না এবং আমার বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই।’
আরও পড়ুনযে কারণে ১০ মাসেও শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনেগণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়সারা পুলিশের, আন্দোলনে নগরবাসীর ভোগান্তিমাদক-বিশৃঙ্খলায় বেসামাল শেকৃবিমামলার বাদী অনিক কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমার ওপর গুলি চালানো হয়। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। এছাড়া ফ্যাসিবাদী শক্তি এটার মদত দেয়। আমি বিচারের জন্য মামলা করি। কিন্তু পরবর্তীসময়ে পাঁচ শিক্ষককে আপসনামা করে মামলা থেকে অব্যাহতি দিই।’
Advertisement
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চোখে গুলি লাগে জবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৪-২০০৫ শিক্ষাবর্ষের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন তিনি।
অপরাধ যদি কেউ করে থাকে, তাহলে তার বিচার হওয়াই স্বাভাবিক। কে অপরাধ করেছে বা করেনি সে বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের। এক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির কোনো পক্ষ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।- শিক্ষক সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন
সুজন মোল্লার মামলায় অভিযুক্ত ৯ শিক্ষক হলেন- রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, একই বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম, নীল দলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া, সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল, সাবেক সহকারী প্রক্টর নিউটন হাওলাদার, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল হোসেন, আইইআর ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ফারুক আহমেদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ সিকেন্দার।
এর মধ্যে দুটি করে মামলা আছে- অধ্যাপক ড. মো. জাকায়িরা মিয়া, নীল দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল, বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস ও নিউটন হাওলাদারের বিরুদ্ধে।
হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা এ মামলার বাদী জবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা রাজনৈতিক ব্যক্তির মতো আচরণ করেছেন। অনেক ছাত্রের জীবন নষ্ট করেছেন। এরা ফ্যাসিস্টদের দোসর। ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের তথ্য প্রশাসনকে দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন। হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ মদতদাতা।’
মামলা থাকা শিক্ষকদের উদ্বেগছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লার মামলায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম গ্রেফতার হওয়ার পর আতংক ছড়িয়ে পড়েছে অন্য শিক্ষকদের মধ্যে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, আমার নামে যে মামলা করা হয়েছে, সেটিকে আমি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে মনে করি। একজন অচেনা শিক্ষার্থীর করা মামলায় আমার নাম আসায় আমি বিস্মিত। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি কখনো দেখিনি, সেও আমাকে চেনে না। এ ধরনের ঘটনায় একজন শিক্ষকের কিছু করার থাকে না—এটা দুঃখজনক।
আনোয়ারা ম্যাডাম যে ক্যাম্পাসে আসবেন আমি অবগত ছিলাম না। পুলিশ ওনাকে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে গ্রেফতার করে। এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক
এছাড়া মামলায় জড়িয়ে আতঙ্কে আছেন অন্য শিক্ষকরাও। অনেকে এ বিষয়ে কথা বলতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিযুক্ত শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, ‘২৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়েছি, সেই শিক্ষার্থীর দায়ের করা মামলায় আজ আমি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। একজন শিক্ষকের দীর্ঘ কর্মজীবনের পরিণতি যদি এমন হয়, তাহলে এটিই কি শিক্ষকতার প্রাপ্তি?’
মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মাশরিক হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমার কোনো কথা নেই।’
কথা বলতে রাজি হননি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক শামসুল কবিরও। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই ঝামেলায় দিন কাটছে। এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।’
শিক্ষক সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অপরাধ যদি কেউ করে থাকে, তাহলে তার বিচার হওয়াই স্বাভাবিক। কে অপরাধ করেছে বা করেনি সে বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের। এক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির কোনো পক্ষ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনো আইনগতভাবে প্রমাণ হয় কোনো শিক্ষক অপরাধে জড়িত তাহলে শিক্ষক সমিতি তার পক্ষে অবস্থান নেবে না। তবে কেউ যদি অযৌক্তিকভাবে হয়রানির শিকার হন, কিংবা কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়ানো হয়, তখন শিক্ষক সমিতি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, ‘আনোয়ারা ম্যাডাম যে ক্যাম্পাসে আসবেন আমি অবগত ছিলাম না। পুলিশ ওনাকে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে গ্রেফতার করে।’
বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ারা বেগমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপগ্রেডেশন বোর্ডে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে, বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মেজবাহ উল আজম সওদাগর জানান, নাম নির্ধারণ সরাসরি রেজিস্ট্রারের পক্ষ থেকে করা হয়, যা আমাদের বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
গ্রেফতারের পরে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিমকে ফোন দিলে তিনিও ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন।
তৌফিক হোসেন/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম