দেশজুড়ে

ঝুড়ি-কুলায় বাঁশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন দুর্গা রাণী

ঝুড়ি-কুলায় বাঁশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন দুর্গা রাণী

এক সময় বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র সংসারের কাজের অন্যতম মাধ্যম ছিল। কালের বিবর্তনে এখন এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে পূর্ব পুরুষের পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের দুর্গা রানী দাস। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করেন। আর তা বিক্রির টাকায় চলছে তাদের সংসার।

Advertisement

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের কুটির শিল্পী শুকুমার দাসের (৫৫) স্ত্রী দুর্গা রাণী দাস (৪৮)। তিনি ছেলের বউ মালা রাণী দাস (২৩) ও মেয়ে অপর্ণা দাসকে (২৫) নিয়ে বাঁশের তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র বানান।

বাঁশ কেটে ডালা, কুলা, চালুনি, খাঁচা, চাটাই, গোলা, মাছ ধরার চাঁইসহ নানা ধরনের খেলনাও তৈরি করেন। বাঁশের সঙ্গে তারা কখনো কখনো বেতও ব্যবহার করে থাকেন। এরপর এসব জিনিস নিয়ে বাড়ির পুরুষরা বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

জীবিকার তাগিদে সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বাঁশের তৈরি এই জিনিসপত্র বিক্রি করে দুর্গা রাণীর সংসার চললেও দিনে দিনে এগুলো বিক্রি কমে যাচ্ছে। নানা ডিজাইন আর কমদামে হাতের কাছেই প্লাস্টিকের জিনিসপত্র পাওয়া যায়।

Advertisement

এ বিষয়ে দুর্গা রাণী দাস বলেন, আমার স্বামী ও ছেলে বিভিন্ন হাট থেকে বাঁশ কিনে আনে। তারপর সেগুলো কেটে চাটাই বানিয়ে দেয়। পরে আমরা সেগুলো বুনে ডালা, কুলা, চালুনিসহ সাংসারিক বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করি। আবার রঙও করি। একবারে ৫০ পিস তৈরির পর তা বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করা হয়। সেই টাকায় চলে আমাদের সংসার।

তিনি আরও বলেন, আমার বয়স যখন সাত-আট বছর। তখন থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে এই কাজ করতে করতে এক সময় শিখে ফেলি। এটি আমাদের বাবা-দাদার পেশা। তাই এটিকে আমরা এখনো ধরে রেখেছি।

আরেক শিল্পী মালা রানী দাস বলেন, বাঁশের তৈরি জিনিপত্রগুলো আগের থেকে এখন একটু কম বিক্রি হয়। তবে টাকা থাকলে ভালোভাবে ব্যবসা করা যায়। আমাদের পূর্ব পুরুষরা করেছেন, আমরাও পরিবারের সবাই এই কাজ করি।

আরেক কুটির শিল্পী অপর্ণা দাস বলেন, একসঙ্গে ৫০ পিস বানিয়ে পাইকারি বিক্রি করতে পারলে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা লাভ হয়। সেই টাকায় আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই এ বিষয়ে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে আমাদের এই কাজ আবার নতুন করে তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

Advertisement

দুর্গা রানী দাসের স্বামী শুকুমার দাস বলেন, বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বাঁশের দামও বেড়েছে। তাই প্রতিটি জিনিস তৈরিতে খরচ হয় ৫৫-৬০ টাকা। আর তা পাইকারি ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারি। এতে প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা থাকে। তা দিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলে যায়।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সমাজে এখনো বাঁশের তৈরি কিছু জিনিসের চাহিদা আছে। কিন্তু টাকার অভাবে তৈরি করতে পারছি না। তাই বিক্রিও কম হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে ভালো করে ব্যবসা করা যেত।

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, নানা কারণে আজ গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কুটিরশিল্প হারাতে বসেছে। কুটির শিল্পীদের যদি আর্থিক সহযোগিতা না করা হয় তাহলে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আর শিল্প যদি না বাঁচে তাহলে আগামী প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঁশের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে। বেড়েছে প্লাস্টিক, অ্যালমুনিয়াম, স্টিল ও কাচের জিনিসের চাহিদা। এজন্য দিন দিন আর্থিক সংকটে পড়েছেন কুটিরশিল্পীরা। এতে করে জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবেশবান্ধব নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় ও বাণিজ্যিক সামগ্রী তৈরির এ ক্ষুদ্র শিল্পগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই শিল্পও পাবে নতুন সম্ভাবনার দিক।

রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহফুজুল হক বলেন, বাঁশ ও বেত শিল্পীদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। তারা যেন কুটির শিল্পের কাজ সুন্দরভাবে করতে পারে সেই লক্ষ্যে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য দ্রুতই সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে। কীভাবে এই শিল্পকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেদিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে।

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/জেডএইচ/জেআইএম