জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে মঙ্গলবার। প্রথমদিন জামায়াতে ইসলামি যোগ দেয়নি।সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক আলোচনায় জোর পেয়েছে বিষয়টি। প্রথমদিনে জাতীয় ঐক্য কমিশনের বৈঠকে যোগদানে বিরত থাকার কারণ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী উল্লেখ করেছে, লন্ডনে ড.মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিদানকে সঠিক মনে করছে না তারা। এমনকি তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে এমন অভিযোগও উত্থাপন করেছে। জামায়াতে ইসলামীর এই ক্ষোভ কি বিএনপির বিরুদ্ধে নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে একটু ভাবনার সুযোগ আছে বৈকি।
Advertisement
জুলাই অভ্যুত্থানের পরে থেকে জামায়াতে ইসলামি ড. ইউনূস সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। অনেকেই মনে করতে থাকে, যেন সরকারি দলের ভূমিকাই পালন করছে জামায়াতে ইসলামী।রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও সমালোচনা করেছে-জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করছে এমন অভিযোগ এনে।জুলাই পরবর্তী প্রতিটি কর্মসূচিতে জামায়াতের অংশগ্রহণও তেমনটাই মনে হতো। সেই জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আয়োজিত দ্বিতীয় দফা বৈঠকের প্রথম দিনে অংশ না নেয়াটাকে তাই ইঙ্গিতবহ মনে করছে বিশ্লেষকদের অনেকেই।
ইতোপূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সমালোচনা হলে যেমন সরকারের হয়ে জবাব দিয়েছে জামায়াত,এবার বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হয়ে জবাব দিয়েছে জামায়াতকে। বিএনপি যৌথ বিবৃতির বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে মনে করে। এবং তারা জামায়াতের অভিযোগের জবাব দিয়েছে তাদেরই মন্তব্যকে উদৃত করে। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ জামায়াতের অভিযোগ খণ্ডনকালে বলেছেন,যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রমজানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে,এটা জামায়াতেরও চাওয়া।
বিএনপি সরকারকে সমর্থন দিতে গিয়ে চুপ হয়ে আছে। এই মুহূর্তে সরকার সমর্থক এনসিপির ভূমিকাও আলোচনায় আসতে শুরু করেছে। তারাও সুযোগ বুঝে একাত্তরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। কিন্তু দিনশেষে তারা ইউনূস পক্ষীয় রাজনীতি করছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফলে সরকার সমর্থক বিএনপি এবং এনসিপি এককাতারে গেলে বাইরে থাকছে জামায়াত। দেখার বিষয় জামায়াত বনাম বিএনপি এই সমীকরণই কি সংসদ নির্বাচনের ফল পর্যন্ত গড়ায় কি না।
Advertisement
জামায়াতে ইসলামী যখন বলে, প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন,তখন বিষয়টিকে হালকা করে দেখার বিষয় থাকে না। কারণ প্রধান উপদেষ্টা কারো প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে পারেন না।যদি করেন, এটা তাঁর শপথভঙ্গ হওয়ার শামিল বলে গণ্য হবে। এমন অভিযোগের পর মনে হতে পারে জামায়াতে ইসলামী সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থানকে স্বীকার করছে না। লন্ডন বৈঠকের পর তাদের এই অভিযোগের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে,জামায়াতের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার যে ঘনিষ্ঠতা ছিল কিংবা প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তারা যতটা আস্থাশীল ছিলো তাতে কি স্পষ্টত ফাটল ধরেনি?
জামায়াতে ইসলামীর অভিযোগের পর আরও বিশ্লেষণ হতে পারে-বিএনপির মতো জামায়াতে ইসলামীও কি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেনি? একক এবং যৌথভাবে এমন মিটিং অন্তত ১০টি করেছে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু এর আগে তাদের বৈঠক নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ কিংবা সমালোচনা হয়নি।তাই লন্ডন বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর ক্ষুব্ধ হওয়াকে ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন অনেকেই।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবারের বৈঠকে যোগদানে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে নতুন কোনো রাজনৈতিক পথ তৈরি করতে চায় কি জামায়াতে ইসলামী? ইতোমধ্যে বিএনপি দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,তারা সরকারকে বিব্রত করার মতো কোনো কাজ করবে না।তাহলে কি জামায়াতে ইসলামী তার আগের পথ থেকে সরে গেছে? যদি তাই হয়,বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইটা নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর মেরুকরণ কেমন হবে? বিএনপি ও জামায়াত একসময় জোটভুক্ত রাজনীতি করলেও কয়েক বছর ধরেই তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। সবশেষে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথম বিরোধ তৈরি হয় আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে। দুটি দলই পরস্পরের কৃতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকে দূরত্বটুকু ছিল নিরাপদ বলয়ে।কিন্তু অচিরেই ক্রমশ দূরত্ব বাড়তে থাকে।বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনটির আগে কোনটি অনুষ্ঠিত হবে, সেই বিষয় নিয়ে।জামায়াত ও নাগরিক পার্টি চায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হোক। বিএনপির এতে- না। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি হয়তো মনে করে, তারা যাতে দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে সেই কৌশল হিসেবেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বিলম্বিত করতে চাইছে।আসলে জামায়াত-বিএনপি মতানৈক্য জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাড়তেই থাকে।আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে সমানতালে লড়াইয়ের চেষ্টা থেকে এই দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
Advertisement
সম্প্রতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাজনক অবস্থানকে সম্বল করে তারা অধিকতর সুবিধাজনক পর্যায়ে যেতে চায়।সেরকম উদ্যোগ ইতোমধ্যে দেখাও গেছে। জামায়াতে ইসলামী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে একাধিক।জোট গঠনের প্রক্রিয়াও চোখে পড়ে।এই জোট গঠনের প্রক্রিয়াকেও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় হিসেবে ভেবে থাকতে পারে।জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে দল গঠনের বিষয়েও জামায়াতের সহযোগিতা রয়েছে বলেও বিএনপির নেতাদের মুখ থেকে অভিযোগ শোনা গেছে।
সাধারণত বিএনপি জামায়াত বিতর্কে একাত্তর প্রসঙ্গ খুবই কম আসে।যখন সম্পর্কের টানাপড়েন একটু বেশি হয়ে পড়ে তখনই তারা একাত্তরকে ব্যবহার করে।এবারও তেমনটা দেখা গেছে।বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি নেতা মেজর হাফিজ জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মনে করা হয়েছিল জামাযাতে ইসলামী হয়তো বিএনপির একাত্তর অস্ত্র ব্যবহারের পর চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-তারা বিএনপির মুখোমুখী হওয়া থেকে বিরত থাকছে না।
বিএনপি সরকারকে সমর্থন দিতে গিয়ে চুপ হয়ে আছে। এই মুহূর্তে সরকার সমর্থক এনসিপির ভূমিকাও আলোচনায় আসতে শুরু করেছে। তারাও সুযোগ বুঝে একাত্তরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে জামায়াতের বিরুদ্ধে। কিন্তু দিনশেষে তারা ইউনূস পক্ষীয় রাজনীতি করছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফলে সরকার সমর্থক বিএনপি এবং এনসিপি এককাতারে গেলে বাইরে থাকছে জামায়াত। দেখার বিষয় জামায়াত বনাম বিএনপি এই সমীকরণই কি সংসদ নির্বাচনের ফল পর্যন্ত গড়ায় কি না।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম