ঘটনা গত ৩০ এপ্রিলের। সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় ৯০টি গরু জব্দ করে ২৮ বিজিবি। পরে জেলার সাংবাদিকদের জানানো হয়, গরুগুলো প্রকাশ্যে নিলামে দেওয়া হবে। বিজিবির পক্ষ থেকে নেওয়া হয় সব ধরনের প্রস্তুতি। কিন্তু নিলামের টিক আগ মুহূর্তে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে বাতিল করা হয় নিলাম প্রক্রিয়া।
Advertisement
গরুগুলো নিলামে তুলতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জেলা প্রশাসন। পরে একজন সহকারী কমিশনারের উপস্থিতিতে ৯০টি গরু জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মায় দেয় বিজিবি। কিন্তু পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, বিজিবির কাছ থেকে জিম্মায় নেওয়া সেই ৯০টি গরুর হদিস মিলছে না। এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক জাকারিয়া কাদির জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (এডিএম) পক্ষ থেকে আসা স্থানীয়দের কাছে জব্দ গরুগুলো জিম্মা দেওয়া হয়েছে।
‘গরু আমি জিম্মায় নিয়ে আসছি শুধু সেটা জানি। তবে এখন কোথায় আছে সেটা জানি না। আমি সত্যি বলছি, আমাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য আদালত আমাকে যে শাস্তি দেবে, আমি মাথা পেতে নেবো।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার ও ছাতক সীমান্ত এলাকায় বেড়েছে পশু চোরাচালান। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে মেঘালয়ের দুর্গম সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে আসছে ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের গরু। এসব গরু পরিবহনের জন্য নৌকার তলদেশে কাঠের পাটাতন ও দুপাশে বাঁশের বেষ্টনী দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ নৌকা। যে নৌকায় করে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নদী পথ দিয়ে অবৈধ এসব গরু বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা ও ধর্মপাশা পশুর হাটে।
Advertisement
আরও পড়ুন:
আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হতে চাই না চাঁদাবাজ ধরলেই ‘ডিটেনশন অর্ডার’, ৭ দিনেই তদন্ত পা হারিয়ে থেমে গেছে জুলাই আহত শফিকুলের জীবন শিশুশ্রম কমছে, বদলে যাচ্ছে শ্রমের ধরনসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুরমা নদীর সাহেব বাড়ি ঘাট এলাকা থেকে গরুবোঝাই নৌকাটি আটক করে বিজিবি। পরে গরুগুলো দেশি নাকি ভারতীয় সেটি যাচাই করতে খবর দেওয়া হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে। পরে অধিদপ্তরের একটি টিম এসে গরুর শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণ করে বিজিবিকে জানায়, মেঘালয়ের গরুর পা ছোট, শিং ছোট, কপালে দাগ, মসৃণ পশমসহ ১০টি বৈশিষ্ট রয়েছে আটক করা গরুগুলোর মধ্যে। এগুলো মেঘালয়ের গরু। পরে বিজিবি গরুগুলো প্রকাশ্যে নিলাম দিতে চাইলে সেখানে বাঁধে চরম বিপত্তি। কারণ অবৈধ এই গরুগুলোতে বাজারের বৈধ ইজারা থাকায় আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বিজিবি। এসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রেজাউল করিমের নেতৃত্বে বিজিবি ক্যাম্পে যায় বোগলা পশুহাট কর্তৃপক্ষের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। পরে সেখানে উপস্থিত থাকা সহকারী কমিশনার মেহেদী হাসান হৃদয় জব্দ করা ৯০টি গরু ও একটি স্টিলবডি নৌকা তাদের কাছে হস্তান্তর করেন।
‘বিষয়টা বোঝেন না? চোরাকারবারি সব। বাইরে থেকে গরু আসে আর বাজারের ইজারাদাররা হাসিল লিখে গরুগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।’
পরে গরুর মালিকানা দাবি করে আদালতে আবেদন করলে আদালত ১০ কর্মদিবসের মধ্যে গরুর মালিকানা সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সুনামগঞ্জ সদর থানাকে নির্দেশ দেন। পরে সদর থানা পুলিশ জিম্মায় নেওয়া গরুগুলো সরেজমিনে দেখতে গেলে গরুগুলোর বিষয়ে তথ্য সঠিক তথ্য দিতে পারেননি জিম্মা নেওয়া ব্যক্তিরা।
Advertisement
সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, আদালতে নির্দেশ অনুযায়ী সুনামগঞ্জ সদর থানার পুলিশের একটি টিম ৯০টি গরুর বিষয়ে তদন্ত করতে যায়। তবে জিম্মায় নেওয়া ব্যক্তিরা গরুগুলো দেখাতে ব্যর্থ হন।
গরু জিম্মায় নেওয়া ব্যক্তিদের একজন দোয়ারাবাজারের বাহার উদ্দিন বলেন, ‘গরু আমি জিম্মায় নিয়ে আসছি শুধু সেটা জানি। তবে এখন কোথায় আছে সেটা জানি না। আমি সত্যি বলছি, আমাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য আদালত আমাকে যে শাস্তি দেবে, আমি মাথা পেতে নেবো।’
আরও পড়ুন:
বাক্সবন্দি মেশিন এখন ‘চায়ের টেবিল’, টেস্ট করাতে হয় বাইরে ব্যবসায়ীদের কড়া বার্তা দিতেই সোহাগকে হত্যা করে বুনো উল্লাস ৫ আগস্টের পর বাহিনী পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন সুব্রত বাইনবড়ছড়া কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘বিজিবি গরু নিলাম দেবে সেজন্য আমি সেখানে উপস্থিত হই। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরে নিলাম প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। গরুগুলো বাজার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমি মনে করি এটা ক্ষমতার অপব্যবহার।’ এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টা বোঝেন না? চোরাকারবারি সব। বাইরে থেকে গরু আসে আর বাজারের ইজারাদাররা হাসিল লিখে গরুগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।’
‘সেদিন আমরা গরুগুলো নিলামে দিতে চেয়েছিলাম। পরে বাজার কর্তৃপক্ষের লোক পাঠান এডিএম। তাদেরই একজন সহকারী কমিশনার, যিনি টাস্কফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন, তার মাধ্যমে গরুগুলো বাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মায় নিয়েছেন।’
গরুগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, গরু জিম্মির বিষয়ে আমার জানা নেই। এটা বিজিবি জানে।
পরে যোগাযোগ করা হলে ২৮ বিজিবির অধিনায়ক একেএম জাকারিয়া কাদির বলেন, ‘সেদিন আমরা গরুগুলো নিলামে দিতে চেয়েছিলাম। পরে বাজার কর্তৃপক্ষের লোক পাঠান এডিএম। তাদেরই একজন সহকারী কমিশনার, যিনি টাস্কফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন, তার মাধ্যমে গরুগুলো বাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মায় নিয়েছেন।’ জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকা জেলা প্রশাসক রেজাউল করিমকে ভারতীয় গরুর জিম্মির বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তিনি অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, জিম্মায় দেওয়া হয়েছে তাতে সমস্যা কী?
গরুগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে না—এ কথা বলতেই তিনি বলেন, আদালতে মামলা চলছে। এটি আদালত বুঝবে।
এসআর/এমএস