নির্জন দ্বীপে ৩১ বছর, করোনার ভয় নেই তার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:১৬ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২০

গোটা বিশ্ববাসীকে চেপে ধরেছে করোনাভাইরাসের ভয়। চীনের পর ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাস যেভাবে লাশের সারি ফেলে চলেছে, তাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কেবল হা-হুতাশই করতে পারছে। কোনো দিশা বাতলাতে পারছেন না চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সংক্রমণ কমাতে কেবল লোকজনকে ঘরে থাকার পরামর্শই দিতে পারছেন তারা। বিশেষ করে একলা থাকার বিষয়টিকে উৎসাহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পুরো দুনিয়া যখন এমন আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায়, তখন একজনই আছেন একেবারে নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারও তার দ্বারে-কাছে যাওয়ারও সুযোগ নেই। সেজন্য তার নেই সংক্রমিত হওয়ার ভয়ও।

jagonews24

তার নাম মাওরো মোরান্দি। যে ইতালিতে করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালাচ্ছে, সেই দেশেরই নাগরিক তিনি। তবে মাওরো আছেন ইতালির মূল ভূখণ্ডের বাইরে ভূমধ্যসাগরের এক জনশূন্য দ্বীপে, দেশটির পূর্বদিকে মাদ্দালিনা দ্বীপপুঞ্জের অংশ বুদেল্লিতে। তবে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পর মাওরো সেখানে যাননি। প্রচলিত বিশ্বের কোলাহল ছেড়ে নির্জন-নৈঃশব্দের ওই দ্বীপে তিনি আছেন প্রায় ৩১ বছর ধরে।

মাওরোর এই নিশ্চিন্তে বসবাস নিয়ে একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ইতালি থেকে নৌপথে পলিনেশিয়ার দিকে (মধ্য-দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) যাত্রা করেছিলেন মাওরো। কিন্তু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটি ভগ্নপ্রায় নৌকায় ভাসতে ভাসতে তিনি পৌঁছান বুদেল্লি দ্বীপে।

Mouro-3.jpg

সেখানে পৌঁছে মাওরো জানতে পারেন, এই দ্বীপের রক্ষক অবসরে যাচ্ছেন। তার বদলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তা তখনো ঠিক করা হয়নি। এই সুযোগই লুফে নেন মাওরো। দ্বীপের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে তিনি ছাড়েন নাগরিক জীবনের মায়া। লেগে যান জনশূন্য দ্বীপ দেখভালের কাজে। সেই থেকে শুরু হয় তার একাকিত্বের জীবন।

এই দ্বীপের বর্ণনায় মাওরো একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নীল জলরাশিতে ভাসতে থাকা এই ভূমি পরিচিত গোলাপি দ্বীপ নামে। গোলাপি রঙের বালুর কারণে দ্বীপটি অনন্যরূপে ধরা দেয়। এখানকার জীববৈচিত্র্যও মোহিত করবে যে কাউকে।

এই জনশূন্য দ্বীপে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়া মাওরো একসময় তার স্বজনদের কাছেই ‘হেয়ালি লোক’ বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এতো বছর পরে এসে হয়তো তারই কোনো বন্ধু-স্বজন ঈর্ষা করছেন ৮১ বছর বয়সী মাওরোকে।

Mouro-3.jpg

স্বদেশিরা যখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে দিন পার করছেন, তখন মাওরো দ্বীপের সুনসান নীরবতায় হাঁটাহাঁটি করে, নীল জলরাশিতে পা ভিজিয়ে, পাথুরে অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে, আর পাতার ছাউনির ঘরে রাত্রিযাপন করছেন। ঈর্ষা হবে না কেন?

মাওরো ডিজিটাল মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ সম্পন্ন করেন। এই মাধ্যমে তিনি রাখেন দেশের খবরও। করোনাভাইরাসের কারণে যে ইতালিতে লকডাউন চলছে, সবাই ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন, জেনেছেন সে খবরও।

তিনি নিজে কেমন আছেন এবং ইতালির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কী ভাবছেন, তা মাওরোর কাছে জানতে চায় সিএনএন ট্রাভেল। মোবাইল ফোনে এই ‘বুড়ো’ প্রকৃতিপ্রেমী বলেন, ‘আমি ভালো আছি, ভীতও নই। এখানে নিরাপদেই আছি। গোটা দ্বীপ সুরক্ষিত। কোনো ঝুঁকি নেই। কেউ এখানে আসে না, এমনকি একটি নৌকাও এই দ্বীপে আসতে পারে না।’

নিজের ‘নির্জন বিশ্বে’ মাওরো নিরাপদ থাকলেও ভাবেন বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ওদের খুব দুঃসময় যাচ্ছে। সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।’

Mouro-3.jpg

দ্বীপের কিছু প্রাকৃতিক খাবারের বাইরে মাওরোকে রোম সরকার বিশেষ ব্যবস্থায় খাবার পাঠিয়ে থাকে। এখন কড়াকড়ির কারণে তার খাবার পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও সতর্কর্তা অবলম্বন করছে কর্তৃপক্ষ।

বয়স ৮১ হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে বেশ সক্রিয় মাওরো। সেখানে তার প্রচুর ফলোয়ারও আছে। যখন তিনি কিছুটা বিষণ্নতা অনুভব করেন, তখন সৈকতের, জীববৈচিত্র্যের বা নীল জলরাশির ছবি তুলে সেগুলো ডিজিটাল ডিভাইসে এডিট করেন, পরে তা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন।

এভাবে ৩১ বছর কাটিয়ে দিলেও মোরাও কখনো নিঃসঙ্গতা অনুভব করেননি। যেতে চাননি তার এ মায়ার দ্বীপ ছেড়েও। একাকী যেভাবে কাটিয়েছেন এতোগুলো বছর, বাকি সময়গুলোও তিনি এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান। মাওরো চান, মৃত্যু যেন তার এই দ্বীপেই হয়, তার শেষকৃত্যও যেন হয় বুদেল্লিতে।

বর্তমান বিশ্ব যে একাকিত্বের কথা (আইসোলেশন) বলে আসছে, মাওরোর মতে, জীবনের প্রকৃত রূপ এটিই। মানুষকে একাই আসতে হয়েছে, আবার একাই যেতে হবে প্রকৃতির কাছে, যেখান থেকে এসেছে সে।

এইচএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।