করোনার ক্রান্তিকাল এলো যেভাবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:১৫ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০২০

চিরচেনা কর্মমুখর পৃথিবী আজ বড্ড অচেনা। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, মানুষজনের হুল্লোড় নেই, কল-কারখানার শোরগোল থেমে নিস্তব্ধ গোটা দুনিয়া। আতঙ্কের এক কালোছায়া যেন ভর করেছে সবার ওপর। এমন ক্রান্তিকাল আগে কখনোই দেখেই বিশ্ববাসী। মাত্র তিনমাসের মধ্যেই অতিক্ষুদ্র এক ভাইরাস কাবু করে ফেলেছে সবাইকে।

এ আতঙ্কের নাম নভেল করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধলক্ষাধিক। অথচ শুরুর দিকে বিষয়টিকে কেউই তেমন পাত্তা দেয়নি। সেসময় একে তুলনা করা হচ্ছিল ২০০৩ সালের সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) ভাইরাসের সঙ্গে, যাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন মাত্র আট হাজারের মতো মানুষ, এর বেশিরভাগই আবার এশিয়ায়। তবে নভেল করোনা অতটা করুণা করেনি। সে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। হাতে গোনা কয়েকটি বাদে প্রায় সবদেশেই হানা দিয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। এটিকে ধরা হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে।

দুর্যোগের শুরু চীনে
ডিসেম্বর ১, ২০১৯। এদিন চীনের উহান শহরের এক বাসিন্দার শরীরে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল নভেল করোনাভাইরাস। ১৬ ডিসেম্বর ওই ব্যক্তিসহ দু’জন নিউমোনিয়া-আক্রান্ত রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠান উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাদের শরীরে সার্সের মতো একটি ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়।

সেসময় হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের পরিচালক আই ফেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ল্যাব টেস্টের রিপোর্টটি শেয়ার করেন। পরে সেটি আরও কয়েকজন চিকিৎসকের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়। তবে তাদের কথাকে দাম দেয়নি চীনা প্রশাসন। বরং ওই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়।

তবে বছরের শেষদিনে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রথমবারের মতো উহানের কয়েক ডজন মানুষ ‘রহস্যময় নিউমোনিয়ায়’ আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ করা হয়। যদিও তখন এ বিষয়ে আর বেশি কিছু জানানো হয়নি। জানুয়ারির ৩ তারিখে থেকে সিঙ্গাপুর, হংকং ও তাইওয়ান- উহানফেরত যাত্রীদের শারীরিক তাপমাত্রা পরীক্ষা শুরু করে।

corona-5.jpg

উহান পেরিয়ে বাইরে
১১ জানুয়ারি সাংহাইয়ের একদল বিজ্ঞানী নতুন ভাইরাসটির জিনগত পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করে। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর উপস্থিতি শনাক্ত করা সহজ হয়ে যায়। ১৩ জানুয়ারি করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্তের কথা জানায় থাইল্যান্ড। এর তিনদিন পরেই জাপানে একজন রোগী পাওয়া যায়। ওই সপ্তাহেই চীনের বেইজিং ও দক্ষিণাঞ্চলীয় গুয়াংডং প্রদেশে করোনাভাইরাসের হানা নিশ্চিত হয়। ২০ জানুয়ারি চীনের রোগ বিশেষজ্ঞ ঝং নানশান জানান, ভাইরাসটি মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ছে।

এরপর থেকেই শুরু হয় করোনা ঝড়। প্রশ্ন উঠতে থাকে এর বিস্তার প্রতিরোধের পদ্ধতি নিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই চীন বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করে। চীনা নববর্ষের মাত্র একদিন আগে ২৩ জানুয়ারি লকডাউন করা হয় উহান শহর, বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচল, ঘরের বাইরে যাওয়ায় দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। কোয়ারেন্টাইন নির্দেশনা বাড়তে থাকে আশপাশের শহরগুলোতেও, দেখতে দেখতে অবরুদ্ধ হয় গোটা হুবেই প্রদেশ।

আক্রান্ত এশিয়া
৩০ জানুয়ারি করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি ও মহামারি ঠেকাতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।

১ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ফিলিপাইনে। এরপর থেকেই এশিয়া অঞ্চলে ভাইরাসটির সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে। এ থেকে বাঁচতে সব স্কুল-অফিস বন্ধ ঘোষণা করে হংকং।

৫ ফেব্রুয়ারি জাপানে ৩ হাজার ৬০০ যাত্রী নিয়ে আটকে পড়ে বিশাল প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেস। ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সাগরেই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় জাহাজটিকে। এর ছয় শতাধিক যাত্রী আক্রান্ত হয়েছেন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে। মারা গেছেন ছয়জন।

corona-5.jpg

দেখতে দেখতেই এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশ হয়ে ওঠে দক্ষিণ কোরিয়া। তবে ব্যাপক হারে পরীক্ষা ও কড়া নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দ্রুতই পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরে তারা।

তখনও করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল চীনেই। সেখানে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। শুধু ১৩ ফেব্রুয়ারিতেই দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হন ১৫ হাজারের বেশি। হুবেইয়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভয়াবহ সংকটে পড়ে। হাসপাতালগুলোতে রোগী ধারণক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, চিকিৎসা উপকরণের সংকট দেখা দেয় চরম আকারে। রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন অনেক মেডিকেলকর্মী। করোনার প্রকোপ শুরুর আগেই এ বিষয়ে সতর্ক করা চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংয়ের মৃত্যুতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে চীনা সরকার। এ ঘটনার জেরে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।

সংক্রমণের নতুন কেন্দ্র ইউরোপ
১৪ ফেব্রুয়ারি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপে প্রথম মৃত্যু হয় ফ্রান্সে। এরপর থেকেই দেশটিতে দ্রুত বাড়তে থাকে রোগের বিস্তার। একসময় তারা ছাপিয়ে যায় চীনকেও। একই সময় করোনার বিস্ফোরণ ঘটে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানেও।

corona-5.jpg

কয়েকদিনের মধ্যেই ইউরোপে মহামারির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ইতালি। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি শহর লকডাউন করে দেয়া হয়। ৯ মার্চের মধ্যে এ নিষেধাজ্ঞা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। পাশ্ববর্তী স্পেনও হয়ে ওঠে নতুন মৃত্যুপুরী। চীনকে ছাপিয়ে তারা হয়ে ওঠে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুময় দেশ। ১৪ মার্চ থেকে সেখানে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।

শুধু সাধারণ মানুষজনই নয়, আক্রান্ত হন বিভিন্ন দেশের বড় বড় নেতারাও। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও প্রিন্স চার্লসের শরীরে করোনা ধরা পড়ে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল কোয়ারেন্টাইনে যান ২২ মার্চ। করোনায় মারা যান ফরাসি মন্ত্রী প্যাট্রিক ডেভেজিয়ান।

আমেরিকায় করোনার হানা
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন ২৯ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু পরীক্ষা স্বল্পতার কারণে সেখানে বেশ কিছুদিন সংক্রমণের হার কম দেখা গেছে। মার্চের মাঝামাঝি করোনা সংকটকে মহাবিপর্যয় ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

শুরুর দিকে হেলাফেলা করলেও ১৩ মার্চ দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটিতে করোনা টেস্টের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, রোগীর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করে পাল্লা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণের হটস্পট হয়ে ওঠে নিউ ইয়র্ক। ৩০ মার্চ আক্রান্তের সংখ্যায় চীনের হুবেই প্রদেশকেও ছাড়িয়ে যায় এ অঙ্গরাজ্যটি। সেখানকার হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেটরের মতো জরুরি মেডিকেল সরঞ্জামের ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। সুরক্ষা উপকরণের সংকট নিয়ে সরব হন মেডিকেলকর্মীরাও।

corona-5.jpg

করোনা সংকট কাটাতে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রণোদনা প্যাকেজ পাস করে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঁচশ’ বিলিয়ন, এয়ারলাইন খাতে ৬২ বিলিয়ন, চিকিৎসা সহায়তায় ১১৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়। সংকটে ভোগা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের নাগরিকদের নগদ অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প।

কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনায় চাকরি হারান লাখ লাখ মার্কিনি। গত ২ এপ্রিল দেশটির শ্রম বিভাগ জানিয়েছে, মাত্র এক সপ্তাহেই ৬৬ লাখেরও বেশি মানুষ বেকারত্ব ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। এর আগেও সপ্তাহেও আবেদন করেছিলেন প্রায় ৩৩ লাখ নাগরিক।

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা
ওদিকে ইউরোপ-আমেরিকা যখন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন চীন-সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ান দেশগুলোতে আবারও করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে মূলত বিদেশফেরত নাগরিকদের।

corona-5.jpg

চীনা কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, গত ১৯ মার্চ দেশটিতে কোনও নতুন সংক্রমণ ছিল না। তবে এরপর থেকে আবারও প্রায় প্রতিদিনই নতুন করে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছেন দেশটির বিভিন্ন জায়গায়। ২০ মার্চ রোগী শনাক্তে নিজেদের নতুন রেকর্ড গড়েছে হংকং ও সিঙ্গাপুর। সংকট মোকাবিলায় কোয়ারেন্টাইন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ কড়াকড়ি বাড়িয়েছে তারা।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ২৫ মার্চ থেকে দেশজুড়ে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে ভারত। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন দেশটির প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ।

মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ করোনার প্রথম প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এনেছে, সেখানে এর ধারা আবারও ফিরে আসতে পারে। ১৯১৮ সালের ফ্লু মহামারিতেও এমনটা দেখা গিয়েছিল। আক্রান্তদের মধ্যে একটি বড় অংশের শরীরেই কোনও ধরনের উপসর্গ দেখায় না। একারণে সচেতনতার অভাব বা অজ্ঞাতসারেই তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি অন্যদের মধ্যে বেশি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ মহামারি আরও কয়েক মাস তাণ্ডব চালাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্র: ব্লুমবার্গ

কেএএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।