করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চীনের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ কেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ১০ এপ্রিল ২০২০

 

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে চীন। করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর প্রথমবারের মতো দেশটির কর্তৃপক্ষ গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, চীনে নতুন করে কোনো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়নি।

তবে বিবিসির রাজনৈতিক প্রতিবেদক রবিন ব্রান্ট বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলছেন, এসব পরিসংখ্যান এবং রোগটির প্রাদুর্ভাব নিয়ে চীনের বর্ণনার বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন ভোর তিনটায় চীনের ভাইরাসের বিস্তারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন দেশটির কর্মকর্তারা। গত ৭ এপ্রিল দেশটি জানিয়েছে, করোনায় চীনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮১ হাজার ৭৪০ জন, আর মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ৩৩১।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল দেশটি যেভাবে এর নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। দ্রুততার সঙ্গে ভাইরাসটি শনাক্ত করা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য চীনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এসব উষ্ণ অভিনন্দন সত্ত্বেও চীনের সরকারি পরিসংখ্যান এবং সাফল্যের দাবি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

গত সপ্তাহে ব্রিটিশ সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মাইকেল গভ বিবিসিকে বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ, প্রকৃতি বা মাত্রা নিয়ে চীনের বেশ কিছু প্রতিবেদন পরিষ্কার নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও গত সপ্তাহে বলেন, চীনের বলা মৃত্যু এবং সংক্রমণের সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে যেন কম করে বলা হয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই মহামারির বিষয়ে সঠিক তথ্য তুলে না ধরার জন্য চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন মার্কিন আইন প্রণেতারা।

বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণ যতো বাড়ছে, যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে, তখন চীনের কাছ থেকে এই শিক্ষা নিতে চাইছে যে দেশটি কীভাবে তাদের পরিস্থিতি এতো নিয়ন্ত্রণে রাখল? কিন্তু এই উদ্বেগও বাড়ছে যে, চীন তাদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্যের ব্যাপারে পুরোপুরি সততা প্রকাশ করেনি।

এসব সন্দেহের পেছনে অতীতের কিছু কারণ রয়েছে। আর সেই সঙ্গে দেশটির স্পষ্টতার অভাবও দায়ী, যা অবিশ্বাস তৈরি করে।

বিশ্বের কাছে বিশ্বাসযোগ্য সরকারি তথ্য উপস্থাপনের ব্যাপারে আগে থেকেই চীনের দুর্নাম রয়েছে। দেশটির অর্থনীতি নিয়ে তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্যি, যা দেশ ও ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রগতির মূল মাপকাঠি তুলে ধরে। অন্য দেশের তুলনায় দীর্ঘদিন ধরে চীনের ত্রৈমাসিক জিডিপি পরিসংখ্যান তার আসল অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় যেন নির্দেশিত তথ্য হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

করোনা মহামারি দেখা দেয়ার আগে ২০২০ সালে সরকার জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ৬ শতাংশ। অতীতের বছরগুলোয় কোনো রকম ভুলত্রুটি ছাড়াই এসব পূর্বাভাস সবসময়ই অর্জিত হয়েছে। তবে চীনের বাইরে এমন কিছু অর্থনীতিবিদ আছেন যারা এটিকে নিছক বর্ণনা হিসাবে গ্রহণ করেন। কারণ এমন আর কোনো অর্থনীতির দেশ নেই, যা সবসময় এরকম সন্দেহজনকভাবে স্থিতিশীল অবস্থা অর্জন করতে পারে।

এসব পূর্বাভাস বা লক্ষ্য অর্জনের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অনেক সময় নির্ভর করে যদি সেটা মিথ্যাও হয়। আরও সহজভাবে বললে, যখন সেটা পার্টির লক্ষ্যের সঙ্গে না মেলে, তখন সেটা গোপন করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তাকে বানোয়াট জিডিপি তথ্য দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

China-2.jpg

অনেকের ধারণা, যে সংখ্যা বলা হয়, চীনের সত্যিকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো তার অর্ধেক। অতীতে কিছু স্বাধীন গবেষণায় সরকারি কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যের চেয়ে কম জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেরিয়ে এসেছে।

চীন যখন জিডিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল বিষয়ের মুখোমুখি হয় (যেমন করোনাভাইরাস), তখন জিডিপির মতোই এক্ষেত্রেও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে অস্বচ্ছ আচরণ করা তাদের কাছে কোনো বিষয় না।

কিছুদিন আগে চীনের হুবেই ও ইয়াংওয়াং কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ সদস্যরা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যেন, বাদ দেয়া এবং চেপে যাওয়া না হয়।

সবাই জানে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ চীনের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়। কিন্তু এটা আর এখন গোপনীয় নয় যে, চীন শুরুর দিকে এটির অস্তিত্ব, বিস্তারের মাত্রা ও ভয়াবহতার তথ্য চেপে রেখেছিল।

উহানের মেয়র অনেকদিন আগেই স্বীকার করেছেন, জানুয়ারির শুরুর দিকে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেননি, যখন প্রায় ১০০ আক্রান্ত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে এই ভাইরাসটির ব্যাপারে চীন প্রথম তথ্য জানায় ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু ততদিনে জানা গেছে, সেই সময়ের মধ্যেই একজন চিকিৎসক ও আরও কয়েকজন সার্সের মতো একটি ভাইরাসের ব্যাপারে তার সহকর্মীদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, যাদের সঙ্গে দেখা করে পুলিশ। ডক্টর লি ও অন্য যারা সতর্ক করেছিলেন, তারা পরে চুপ হয়ে যান। পরবর্তীতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ডক্টর লি।

কয়েক সপ্তাহ আগে যখন প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর প্রথমবারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উহান সফর করেন, সেই সময়ে হুবেই প্রদেশ ছাড়া মূল দেশটিতে নতুন করে আর কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি।

শি জিনপিংয়ের ওই সফরের সময় জাপানের বার্তা সংস্থা কিয়োডো উহান শহরের একজন চিকিৎসকের নাম প্রকাশ না করে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে ওই চিকিৎসকের বরাতে বলা হয়, কর্মকর্তারা চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন, নতুন রোগীদের তথ্য সরকারি তথ্যে যুক্ত করা না হয়।

ব্লুমবার্গে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তারা আরও একধাপ এগিয়ে গেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউজে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীনের তথ্য-উপাত্ত ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্পূর্ণ এবং সংখ্যাগুলো বানানো।

মহামারি নিয়ে তথ্য গোপনের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, হয়তো সংখ্যাটি কয়েকগুণ বেশি, ফলে সেটি জনগণকে না জানিয়ে স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থার তথ্য গোপন করে রাখাই উদ্দেশ্য। হয়তো সেটা আতঙ্ক তৈরি না করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। অথবা এই আশায় হতে পারে যে এটা আর বেশি বাড়বে না এবং এসব তথ্য কখনোই প্রকাশ পাবে না।

চীনের এসব তথ্য যদি সত্যি হিসেবেও ধরে নেয়া হয়, তারপরও দেশটির সংখ্যার বিষয়ে সততা নিয়ে অতীতে অনেকবারই প্রশ্ন উঠেছে। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত করোনার সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে সাত রকমের তথ্য দিয়েছে।

হংকং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক বেন কাউলিং বলছেন, প্রথমদিকে পরীক্ষাগুলো করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদের, যাদের গুরুতর নিউমোনিয়ার সমস্যা এবং উহানের মাছ-মাংসের বাজারের সঙ্গে কোনোরকম সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ওই বাজারটি থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়।

তার ধারণা, পরবর্তীতে যেসব সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেগুলো যদি প্রথম থেকে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে নিশ্চিত রোগীর সংখ্যা হতো ২ লাখ ৩২ হাজার। চীনে যতো রোগী শনাক্তের কথা বলা হয়েছে, এই সংখ্যা তার তিনগুণ।

অধ্যাপক বেন কাউলিং বলেন, আমরা ধারণা করি, প্রথমদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবটি নিয়ে অনেক বেশি অবহেলা করা হয়েছে। সেই সময়ে এমন অনেকে ছিলেন, যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। পরবর্তীতে তাদের শনাক্ত বা নিশ্চিত হলেও, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এসব তথ্য তালিকাভুক্ত করেনি চীন।

তিনি আরও বলেন, জাপানের ডায়মন্ড প্রিন্সেস ক্রুজ শিপে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়নি এমন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং তার আশেপাশে যারা রয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে তাদের ভাবমূর্তি এবং চীনের অবস্থান উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

গত সপ্তাহে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বলেন, স্থানীয় সব কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে খোলামেলা এবং স্বচ্ছ হবেন।

ড. লি এবং অন্য যারা প্রথমে ভাইরাসের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন এবং পরবর্তীতে মারা গেছেন, তাদের জাতীয় শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

উহানে লকডাউন কার্যকর করার কয়েক সপ্তাহ পরে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করে, প্রেসিডেন্ট জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে এ ধরনের কোনো খবর জানানো হয়নি। ইতালির মতো যাদের জরুরি সাহায্য দরকার, তাদের জন্য সাহায্য ও চিকিৎসক পাঠিয়েছে চীন। সার্বিয়ার মতো অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রকেও পাঠিয়েছে।

চীনের সরকার দাবি করেছে, মানব শরীরে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম দফার পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে তথ্য-উপাত্ত সত্য-মিথ্যা যাই দেয়া হোক না কেন, এটা পরিষ্কার যেন এই সংকটের গভীরতর অবস্থা থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে চীন। এটাও পরিষ্কার যে, দেশটি বিশ্বে মহামারির জন্ম দিয়েছে, তারাই এর অবসানের চেষ্টা করছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এমএসএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।