করোনার দ্বিতীয় ঢেউ: এশিয়া থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে?
করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ হয় এশিয়ায়, সেখানেই প্রথম লকডাউন কার্যকর করা হয়। আবার প্রথম এশিয়াতেই লকডাউন তুলে নেয়া হয়। সেখানেই প্রথম নতুন ধারার সংক্রমণ দেখা যায়, গুচ্ছ সংক্রমণ সিউলের নাইট ক্লাব থেকে রাশিয়া-চীন সীমান্ত পর্যন্ত।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এশিয়া থেকে তাহলে কী শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে?
১. ভাইরাসের একটা ঢেউ, তীব্রতা অথবা গুচ্ছ সংক্রমণ- যা এড়ানোর উপায় নেই
ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আলোচনায় প্রথমেই সামনে আসে তীক্ষ্ণতা অথবা গুচ্ছ আকারে নতুন শনাক্তের হারের বিষয়টি। কিন্তু এগুলো দিয়ে কী বোঝানো হয়?
দ্বিতীয় ঢেউ বলতে বোঝানো হয়, প্রথম দফায় সংক্রমণের পরে আবার নতুন করে জনগোষ্ঠীর আরেক অংশে রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অতীতের মহামারিগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেগুলো কয়েকমাস জুড়ে কয়েক দফায় ঘুরেফিরে আঘাত এসেছে।
এশিয়ায় দেখা গেছে, ভিন্ন ভিন্নভাবে গুচ্ছ আকারে এবং আঞ্চলিকভাবে রোগের সংক্রমণ বেড়েছে। সেটি কীভাবে আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা এখনই বলা কঠিন।
কিন্তু ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জীববিজ্ঞানী জেনিফার রোহন মনে করেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই, বরং প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কখন আর কতটা ভয়াবহভাবে আঘাত করবে?
এমনকি যেসব দেশ সফলভাবে পরীক্ষা, যোগসূত্র খুঁজে বের করা এবং লকডাউন ব্যবস্থাপনা করেছে-যেমন দক্ষিণ কোরিয়া- সেসব দেশেও গুচ্ছ আকারে রোগটির সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে।
সুতরাং যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, ভাইরাস আরো কিছুদিন থেকে যাবে, তার মানে হলো বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হতে থাকবে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে সে বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়া যাবে, কীভাবে তাদের শনাক্ত করা হবে এবং তাদের ব্যবস্থাপনা কী হবে?
২. কড়াকড়ি আবার হয়তো ফিরে আসবে
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের জনস্বাস্থ্য নীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অ্যালিস্টার ম্যাকগুইয়ার বলেন, খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। একটি সফল লকডাউনের মানে এই নয় যে, কোন একটি এলাকা থেকে করোনাভাইরাস দূর হয়ে গেছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে যেসব এলাকায় প্রথম লকডাউন জারি করা হয়, তার একটি জাপানের হোক্কাইডো অঞ্চল। মধ্য মার্চ নাগাদ সেখানে প্রতিদিন রোগী শনাক্তের সংখ্যা একজন, দুইজনে নেমে আসে।
সেখানে নেয়া কড়াকড়ি ব্যবস্থা এতোটাই ভালো কাজ করেছিল যে, এপ্রিল নাগাদ বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়, স্কুল আবার খুলে দেয়া হয়। কিন্তু একমাসের মধ্যে আবার সেখানে নতুন করে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়। কারণ ওই দ্বীপটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় দফা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় দফার জরুরি অবস্থা এখন তুলে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা জানেন, যতদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হবে, ততদিন আবার এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। চীনের কড়াকড়ি তুলে নেয়ার পর মে মাসের মাঝের দিকে আবার নতুন করে গুচ্ছ আকারে সংক্রমণ পাওয়া যেতে শুরু করে। তার মধ্যে রয়েছে উহানের মতো শহরও, যেখানে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সিউলের বাইরে নতুন করে সংক্রমণ দেখা দিলে, খুলে দেয়ার কয়েকদিনের মধ্যে আবার দুইশ'র বেশি স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
৩. বিদেশে থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন করা
চীনের প্রদেশ জিলিন এবং হেইলংজিয়ানে প্রতিবেশী রাশিয়া থেকে নতুন রোগী আমদানি হয়েছে বলে মনে করা হয়। একটি ঘটনায় দেখা যায়, রাশিয়া থেকে আসা আটজন রোগী কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন। যার ফলে ওই এলাকায় ভ্রমণ করা ৩০০ মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।
বেশ কিছুদিন ধরেই চীনে দেখা গেছে, স্থানীয় শনাক্তের তুলনায় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে রোগী শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। রোগ ঠেকাতে সেখানে কঠোর কোয়ারেন্টাইন করার পদক্ষেপও নিতে হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বেইজিংগামী সব আন্তর্জাতিক বিমানকে অন্যান্য শহরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেখানে যাত্রীদের পরীক্ষানিরীক্ষা এবং কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট ব্যবহারের বাধ্যতামূলক পদ্ধতি চালু করেছে হংকং। যাতে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টাইন করা যায়।
এগুলোকে হয়তো ততোটা নির্দোষ পদক্ষেপ বলা যাবে না, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এ রকম কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে।
৪. পরীক্ষা এবং সন্ধান বন্ধ করা যাবে না
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে দক্ষিণ কোরিয়া দ্রুত একটি পদ্ধতি চালু করে; যার ফলে প্রতিদিন তারা প্রায় ১০ হাজার পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে তারা নতুন রোগীদের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করার জন্য অ্যাপস ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে, যার ফলে তারা দ্রুত মহামারি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়।
ড. রোহন বলছেন, এর ফলে তারা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে যে, সার্বিকভাবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, যদি কোথাও গুচ্ছ আকারেও নতুন রোগী শনাক্ত হয়, তখন স্থানীয়ভাবে সেই স্থানটি লকডাউন করে ফেলা সম্ভব হয়।
এরকম গুচ্ছ আকারে শনাক্তের একটি উদাহরণ রেকর্ড হয় ১২ মে। এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশে কোন নতুন রোগী পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেদিন সিউলের একটি জনপ্রিয় নাইটক্লাব এলাকায় নতুন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর তারা অনুসন্ধান করে সংস্পর্শে আসা অন্তত ৯০ হাজার মানুষকে শনাক্ত করে।
ওই ঘটনায় ৩০০ নতুন সংক্রমণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক ম্যাকগুইয়ার বলছেন, আমরা সবাই জানি, এটা সত্যিই ভয়াবহ একটি সংক্রামক রোগ। দক্ষিণ কোরিয়ায় কী ঘটেছে, সেটা যদি আপনি দেখেন, যারা এই ক্ষেত্রে কার্যকর একটি নীতি নিয়েছে...। কিন্তু যখন সেটি শিথিল করা হয়, তখন আবার রোগের সংক্রমণ ফিরে এসেছে।
কোরিয়ার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (কেসিডিসি) এসব সংক্রমণের বেশ কয়েকটি ঘটনার উৎস খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী চীনের শহর শুলানে যে লন্ড্রি কর্মীর মাধ্যমে আরো ১৩ জন সংক্রমিত হয়েছিলেন, তাকে খুঁজে বের করতে পেরেছেন চীনের কর্মকর্তারা। কিন্তু ওই কর্মী কীভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন তা জানা যায়নি।
চীনের সিডিসি বলছে, তারা এই ঘটনার আরো তদন্ত করে দেখবে যে, ওই কর্মীর শরীরে থাকা ভাইরাসটি রাশিয়ার ভাইরাসের একটি সংস্করণ কিনা? চীনের মহামারি বিশেষজ্ঞ উহু জুনইউ বলছেন, যতদিন পর্যন্ত নতুন শনাক্ত হওয়া রোগীদের ঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যাবে, ততদিন এই মহামারি দমিয়ে রাখা যাবে এবং সেটির বিস্তার ঘটতে পারবে না।
তিনি মনে করেন, পরীক্ষা এবং রোগীদের সংস্পর্শের বিষয়টি অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৫. একবার নয়, দু'বার পরীক্ষা করুন
অধ্যাপক ম্যাকগুইয়ার বলছেন, কে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, শুধু সেটা জানাই যথেষ্ট নয়, বরং অ্যান্টিবডি পরীক্ষাও করা উচিত। যাতে কার কার সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, সেটা জানা যায়।
তিনি বলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই ব্যক্তিরা হয়তো ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সময়ে তাদের আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সিঙ্গাপুরে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার শুরুর দিকে পরস্পরের কোন যোগসূত্র নেই, এমন দুইটি ক্লাস্টারে দু'জন ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়, যাদের কোন লক্ষণ ছিল না। এটা ছিল দেশটির কর্তৃপক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার ফলে তারা একটা সময় পর্যন্ত ভাইরাসের বিস্তার আটকে রাখতে পেরেছিলেন।
ডিউক-এনইউএস মেডিকেল কলেজ সিঙ্গাপুরের সহকারী অধ্যাপক অ্যাশলে সেন্ট জন বলছেন, যেহেতু এই ভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষণহীন বা সামান্য লক্ষণ থাকতে পারে, ফলে একজন ব্যক্তি নিজেকে অসুস্থ জানার আগেই সেটা ছড়িয়ে পড়তে পারে। সর্বত্র রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করা হয় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু সিঙ্গাপুরে সেটা পরীক্ষা করেই গুচ্ছ আকারে ভাইরাসের বিস্তার আটকে রাখা এবং সন্দেহজনক রোগীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
সিঙ্গাপুরে পুরো দেশজুড়ে এটি ব্যবহার করা না হলেও বিভিন্ন শ্রেণী পেশা ভিত্তিক যাচাই করে দেখা হয়েছে। যেমন স্কুলের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ইমিউনিটি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
তাদের যুক্তি হচ্ছে, যারা একসময় আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু এখন সুস্থ হয়ে গেছেন তাদের মাধ্যমে আর রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই। অতএব তাদের এখন কাজে ফেরত পাঠানো যায়।
৬. একটি অনুকূল জনস্বাস্থ্য সেবা
ইউনিভার্সিটি ডে বার্সেলোনার স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক জুডিথ ভ্যাল বলছেন, নানা ঘটনা থেকে দেশের জনস্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কি শিখতে পারছে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মহামারির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ প্রমাণ করেছে যে, এটা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার আর দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মাত্র আটদিনে উহানে ১ হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল তৈরি করেছে চীন। সেই সঙ্গে কীভাবে জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলো সেবা দেবে সেসব পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করেছে।
তিনি বলেন, সারা বিশ্বের হাসপাতাল এবং প্রাথমিক সেবা কেন্দ্রগুলো একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছে। কিন্তু তারা নিজেদের কাজেও অনেক শিখছে। সুতরাং যখন দ্বিতীয় দফার আঘাত আসবে, সেটা সামলাতে তখন তারা ভালো একটা অবস্থায় থাকবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন করে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। যাতে দেশগুলো যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে পারে।
সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক ভ্যাল।
ড. রোহন বলছেন, জনগোষ্ঠীর ভেতরে এই ভাইরাসটি ঠেকানোর কোন সক্ষমতা নেই। যতদিন না একটি কার্যকরী এবং সহজলভ্য টিকা পাওয়া যাবে, আমরা সবাই ঝুঁকির ভেতরে থাকবো।
৭. কোথাও একমাত্র সমাধান নেই
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পশ্চিম প্রশান্ত অঞ্চলের কোভিড-১৯ ইনসিডেন্ট ম্যানেজার ড. নাওকো ইশিকাওয়া বলেন, এই মহামারি সামলাতে গিয়ে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়তো এটা যে, এখানে একমাত্র কোন উপায় নেই; যা দিয়ে সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র একজনের পরীক্ষা করে নয় বা একজনের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করলে হবে না। এই অঞ্চলের অনেক দেশ এসব করেছে পুরো সরকারের, পুরো সমাজের সব ব্যবস্থাপনা সঙ্গে নিয়ে। জনগোষ্ঠীর ভেতরে এই ভাইরাসটি ঠেকানোর কোন সক্ষমতা নেই। যতদিন না একটি কার্যকরী এবং সহজলভ্য টিকা পাওয়া যাবে, আমরা সবাই ঝুঁকির ভেতরে থাকবো। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমকেএইচ