ফ্যাক্ট চেক: করোনার প্রাদুর্ভাব কি আগস্টে শুরু হয়?
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে সম্প্রতি আভাস দেয়া হয়েছে যে, চীনের উহান শহরে হয়তো গত বছরের আগস্ট মাসেই করোনাভাইরাস দেখা দিয়েছিল। তবে শুধু চীনই যে ওই জরিপটি অবিশ্বাস্য রকমের হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেয়, তাই নয়—কিছু নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিকও এই জরিপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
জরিপটির নানা দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন বিবিসির ‘রিয়েলিটি চেক্’ বা ‘ফ্যাক্ট চেক’ বিভাগের সাংবাদিক ক্রিস্টোফার জাইলস, বেঞ্জামিন স্ট্রিক এবং ওয়ানউয়ান সং। তাদের যাচাই শেষে যেসব তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো বিবিসির ১৪ জুনের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। সেসব বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।
গবেষণায় কী বলা হয়েছিল?
জরিপটির ভিত্তি হচ্ছে উহান শহরের হাসপাতালগুলোর আশপাশে যানবাহন চলাচলের উপগ্রহ চিত্র এবং কিছু বিশেষ শারীরিক অসুস্থতার উপসর্গের ব্যাপারে ইন্টারনেটে অনুসন্ধানের উপাত্ত। জরিপটি ‘পিয়ার-রিভিউ’ হয়নি অর্থাৎ একই বিষয়ে গবেষণারত অন্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা তা পর্যালোচনা করানো হয়নি।
জরিপে বলা হয়, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকে ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত সময়কালে উহান শহরের ছয়টি হাসপাতালের বাইরে পার্ক করা গাড়ির সংখ্যায় চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি দেখা যায়।
হার্ভার্ডের রিপোর্ট বলছে, ওই সময় ইন্টারনেট সার্চে ‘কাশি’ এবং ‘ডায়রিয়ার’ মতো শব্দের সংখ্যা বেড়ে যায়—যা করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য দুটি লক্ষণ। এখন, এই তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, কারণ উহান শহর থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর ডিসেম্বরের শুরুর আগে পাওয়া যায়নি।
হার্ভার্ডের জরিপ রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ‘এটা ঠিক যে আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না হাসপাতালে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ভাইরাসের কোন সরাসরি সম্পর্ক আছে। তবে সম্প্রতি অন্য কিছু কাজ হয়েছে যাতে দেখা যায় যে হুয়ানান সি-ফুড মার্কেট চিহ্নিত হবার আগেই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এর সঙ্গে আমাদের পাওয়া তথ্যপ্রমাণগুলো মিলে যাচ্ছে।’
হার্ভার্ডের এই জরিপটি মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই গবেষণার ব্যাপারে ফক্স নিউজের একটি খবর টুইট করেছিলেন যা ৩০ লাখ বারেরও বেশি খুলে দেখা হয়। তিনি অবশ্য প্রথম থেকেই ভাইরাসটি চীনের ল্যাবে তৈরি বলে দাবি করে আসছেন; যার প্রমাণ মেলেনি।
এই তথ্যপ্রমাণ কি তাহলে ধোপে টেকে?
চীনের জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন বাইদু-তে আগস্ট-ডিসেম্বর সময়কালে বিশেষ করে ‘ডায়রিয়া’ শব্দটি নিয়ে অনলাইনে অনুসন্ধান বেড়ে গিয়েছিল—এই দাবি করছে হার্ভার্ডের জরিপটি। কিন্তু বাইদুর কর্মকর্তারা এই তথ্যের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ওই সময় বরং ‘ডায়রিয়া’ শব্দটি নিয়ে ইন্টারনেট সার্চের পরিমাণ কমে গিয়েছিল।
তাহলে ব্যাপারটা কী? কী ঘটছে আসলে?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, চীনা ভাষায় তার অনুবাদ হচ্ছে ‘ডায়রিয়ার লক্ষণ’। গুগল ট্রেন্ডের মতোই বাইদুতে জনপ্রিয় অনুসন্ধানগুলোর বিশ্লেষণ করার একটি টুল আছে এবং বিবিসি তা পরীক্ষা করে দেখেছে।
তাতে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ‘ডায়রিয়ার লক্ষণ’ শব্দটি নিয়ে অনুসন্ধানের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কিন্তু বিবিসি রিয়েলিটি চেক্ বিভাগ যখন ‘ডায়রিয়া’ শব্দটি নিয়ে সার্চ দেয়—যা উহানে অধিক ব্যবহৃত—তখন আবার দেখা যায় যে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর সময়কালে এ শব্দটির অনুসন্ধান কমেছে।
হার্ভার্ডের রিপোর্টটির অন্যতম লেখক বেঞ্জামিন রেডার বিবিসিকে বলেন, তারা ডায়রিয়ার সমার্থক শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন কারণ কোভিড-১৯ ভাইরাস এবং এতে আক্রান্তদের জন্য এটাই সবচেয়ে বেশি মিলে যাচ্ছিল। এ ছাড়া করোনার আরও দুটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। বিবিসি এ দুটি শব্দও ইন্টারনেট অনুসন্ধানে কতটা জনপ্রিয় তা পরীক্ষা করে দেখেছে।
তাতে দেখা যায়, আগস্ট মাসের পর থেকে ‘জ্বর’ শব্দটি নিয়ে অনুসন্ধান যতটা বেড়েছে তার পরিমাণ সামান্য এবং ‘কাশি’ শব্দটির অনুসন্ধানের হারের সমতুল্য। অন্যদিকে ওই একই সময়ে ‘শ্বাসকষ্ট’ শব্দটি অনুসন্ধানের পরিমাণ কমেছে।
হার্ভার্ডের জরিপে করোনাভাইরাসের লক্ষণ হিসেবে যেভাবে ‘ডায়রিয়াকে’ বিবেচনা করা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাজ্যে ১৭ হাজার রোগীর ওপর এক জরিপ চালিয়ে দেখা গিয়েছিল যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ হিসেবে ডায়রিয়ার স্থান হয় সাত নম্বরে—শীর্ষ তিনটি লক্ষণ কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের অনেকটা নিচে।
গাড়ির সংখ্যার ব্যাখ্যা কী?
হার্ভার্ডের জরিপে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬টি হাসপাতালের পার্কিং এলাকায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাবার কথা বলা হয়। তবে বিবিসির অনুসন্ধানে তাদের এ বিশ্লেষণে কিছু গুরুতর ত্রূটি দেখা গেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যেসব উপগ্রহ ছবিতে কিছু অংশ গাছ দিয়ে ঢাকা ছিল বা অন্য ভবনের ছায়া পড়েছে—সেগুলো বিবেচনা করা হয়নি, যাতে গাড়ির সংখ্যা গণনায় ভুল হতে পারে।
কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যেসব ছবি প্রকাশ করা হয় তাতে দেখা যায় হাসপাতালের কারপার্কের বড় অংশ আশপাশের উঁচু ভবনে ঢাকা পড়ে গেছে—যার অর্থ সেখানে থাকা গাড়ির সংখ্যা নির্ভুলভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়।
তিয়ানইউ হাসপাতালে একটি কারপার্ক আছে যা মাটির নিচে, ফলে তাতে কি পরিমাণ গাড়ি আছে তা উপগ্রহ চিত্রে নেই। বেঞ্জামিন রেডার বলেন, ‘আমাদের পক্ষে মাটির নিচের কারপার্কে থাকার গাড়ির সংখ্যা দেয়া সম্ভব নয় এবং এটা জরিপের একটি সীমাবদ্ধতা।’
এছাড়া জরিপটিতে যেসব হাসপাতাল বেছে নেয়া হয়েছে তা-ও উদ্বেগের বিষয়। এতে বেছে নেয়া ছয়টি হাসপাতালের একটি হচ্ছে হুবেইয়ের নারী ও শিশু হাসপাতাল—যদিও করোনাভাইরাসের জন্য শিশুদের খুব কম সময়ই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়।
জবাবে জরিপটির প্রণেতারা বলছেন, এ হাসপাতালটি জরিপ থেকে বাদ দেয়া হলেও সার্বিকভাবে ওই সময়টায় হাসপাতালগুলোতে আসা গাড়ির সংখ্যা বেশি দেখা যাবে।
গবেষকরা হয়তো তাদের উপাত্ত চীনের অন্য শহরগুলোর সঙ্গে তুলনা করতে পারতেন—যাতে বোঝা যেতো যে হাসপাতালে গাড়ির সংখ্যা এবং ইন্টারনেট সার্চ শুধু উহান শহরেই বেশি ছিল কিনা—যে শহরটি থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের সূচনা।
এ তুলনা ছাড়া উহানের বাসিন্দারা আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন—এমন সিদ্ধান্তের তথ্যপ্রমাণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। তবে এটা ঠিক যে উহানে একেবারে প্রথম দিকে ভাইরাস কীভাবে ছড়িয়েছিল সে সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা।
এসএ