বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ কম কেন?
অডিও শুনুন
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় ধাঁধাটি হয়তো লুকিয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। করোনার উৎস চীন এবং এই মুহূর্তে সংক্রমণের অন্যতম হটস্পট ভারতের একেবারে কাছে হওয়া সত্ত্বেও কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারের মতো পুরোপুরি বা আংশিক বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে ভাইরাসের প্রকোপ নেই বললেই চলে।
এক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করতে হয় ভিয়েতনামের কথা। ৯ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে করোনায় কেউ মারা যায়নি; সাত কোটি জনসংখ্যার থাইল্যান্ডে প্রাণহানি ৫৮টি, গত ৪০ দিন ধরে সেখানে স্থানীয়ভাবে কেউ আক্রান্ত নেই; দারিদ্র্যপীড়িত মিয়ানমারে মোট ৩১৭ রোগীর মধ্যে মারা গেছেন মাত্র ছয়জন। এছাড়া কম্বোডিয়া (১৪১ জন আক্রান্ত) এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লাওসেও (১৯ জন আক্রান্ত) করোনায় মৃত্যুর রেকর্ড তো নেই-ই, গত এপ্রিল থেকে সেখানে স্থানীয়ভাবে কোনও সংক্রমণও হয়নি।
অথচ এদের পাশ্ববর্তী দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া (আক্রান্ত ৬৮ হাজার, মৃত ৩ হাজার ৪০০) ও ফিলিপাইনে (আক্রান্ত ৫০ হাজার ৪০০, মৃত ১ হাজার ৩০০) এখনও তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস।
কারণ কী?
সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের ব্যাখ্যা বাদ দিলে এর পেছনে আরও কিছু কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের বিষয়টা ব্যাখ্যা করাই সবচেয়ে সহজ। চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের হাজার বছরের ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকলেও চীনাদের প্রতি তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস নেই। বছরের শুরুর দিকে চীন বারবারই করোনাভাইরাসের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও তা মানেনি ভিয়েতনাম। তথ্যের জন্য তারা সাইবার হামলাও চালিয়েছিল। মহামারির শুরুতেই সীমান্ত বন্ধ করে দেয় ভিয়েতনাম, সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো দেশ লকডাউন করা হয়, আক্রান্ত বা ঝুঁকিপূর্ণদের খুঁজে বের করে আলাদা করার ব্যবস্থা করা হয়। পরে কিন্তু চীনও সেই একই কাজ করেছে।
চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করার মতো উদ্ধত ক্ষমতা এবং কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব কম দেশেরই আছে। এক্ষেত্রে জেনারেলদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত থাইল্যান্ডই হয়তো তাদের সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নত মানের জন্য থাইল্যান্ড আগে থেকেই মেডিকেল ট্যুরিজমে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। তাছাড়া, দেশটির সরকারও দ্রুততার সঙ্গে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে টাস্কফোর্স গঠন করেছিল।
ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ করে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। তবে লাওসের মতো ছোট দেশের জন্য চীনের প্রভাব উপেক্ষা করা এককথায় অসম্ভব ছিল। চীনা ব্যবসায়ী ও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম রয়েছে মিয়ানমারে, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী তো চীনের অন্যতম গুণগ্রাহী। চীনা অর্থায়ন এসব দেশের পটপরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, ফলে ঝুঁকি সত্ত্বেও সীমান্ত বন্ধ না করতে তাদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট চাপ ছিল।
মহামারির মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারিতে চীন ভ্রমণ করেছেন কম্বোডিয়ান প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। মার্চ থেকে চীনাদের জন্য দ্বার খুলে দিয়েছে থাইল্যান্ড। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সীমান্ত এককথায় শত ছিদ্রযুক্ত। তাহলে এসব দেশে চীন থেকে ভাইরাস ছড়াল না কেন?
এ বিষয়ে অনেক বড় একটা সন্দেহ রয়েছে যে, সংক্রমণ আসলে ঘটেছে, কিন্তু তা প্রকাশ করা হয়নি। কম্বোডিয়া, লাওস এবং মিয়ানমারে করোনা টেস্টের সংখ্যাও একেবারে কম।
মিয়ানমারে একাধিক হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ‘মেডিকেল অ্যাকশন মিয়ানমার’ নামের একটি দাতব্য সংস্থার প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক স্মিথুইস বলেছেন, দেশটিতে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটলে অবশ্যই তার সংস্থার নজরে আসত। তার মতে, মিয়ানমারের মতো আলোচিত একটি দেশে মহামারি গোপন করা মোটেও সম্ভব নয়।
কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন, ব্যাপক হারে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অবশ্যই বাড়ত। তবে এখন পর্যন্ত তারা এধরনের কোনও প্রমাণ পাননি।
রহস্যের মূলে
ব্যাংককের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক থিতিনান পংশুধিরাক জানিয়েছেন, থ্যাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের গ্রামের বাইরে একটি আলাদা বাড়িতে অন্তত ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে সংক্রমণ কম থাকায় তাদের আরও যেসব বিষয় সাহায্য করেছে তার মধ্যে রয়েছে, শহুরে ভিড়ের চেয়ে সেখানে গ্রামে বেশি মানুষ বসবাস করে, এয়ারকন্ডিশনারের বদলে তারা খোলা জানালা আর পাখার ওপর বেশি নির্ভরশীল, অঞ্চলগুলোতে যুবকদের সংখ্যাধিক্য এবং আগে থেকেই মাস্ক পরার প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া, বৌদ্ধদের মধ্যে করজোড়ে সম্মান জানানোর প্রথাও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এসব বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলো করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ কি সামাল দিতে পারবে?
থিতিনান পংশুধিরাক বলেন, চীন থেকে সংক্রমণ কম ছড়ানো কোনও আশ্চর্যজনক বিষয় নয়। বিশাল এ প্রতিবেশী দেশটি দ্রুতই মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। এখন সংক্রমণের গতিপথ বদলাচ্ছে, এশিয়ায় সারাবিশ্ব থেকে ভাইরাস আসছে। এর ফলে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের বীজ রোপিত হচ্ছে। এছাড়া, চলতি সপ্তাহে বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে মন্দিরে জড়ো হওয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে, করোনা সুরক্ষার এ দেয়াল কত সহজে ভেঙে পড়তে পারে।
(দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত)
কেএএ/পিআর